published : ২৯ মে ২০২৫
কোয়ান্টাম মেথড হলো সুস্থতা, সাফল্য ও সুখের ২৮টি সূত্রে গাঁথা একটি টুলবক্স, কম্প্যাক্ট সুইস নাইফের মতোই যা জীবনকে সুন্দর করার জন্যে যে-কোনো সময়, যে-কোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করা যেতে পারে। মেডিটেশনের এত বহুমুখী ব্যবহারের কথা কোয়ান্টাম বলছে প্রায় ৩ দশক ধরে।
২৯ নভেম্বর ২০২৪ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সর্বসম্মতিক্রমে ২১ ডিসেম্বরকে ঘোষণা করা হয় বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। শারীরিক মানসিক ও আবেগিকভাবে ভালো থাকার জন্যে মেডিটেশন চর্চার গুরুত্বেরই এ এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
এই ঘোষণার আগেই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ২০২৫ সালকে ঘোষণা করে ‘দ্য ইয়ার অব মেডিটেশন’। এরই প্রেক্ষিতে এই সিরিজ আর্টিকেল, যা মূলত কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের আলোচনাগুলোর অ্যাডাপ্টেশন।
………………………………………………………………………………………………..
আমরা সফল হতে চাই, কিন্তু সাফল্যের রহস্য আমাদের কাছে উন্মুক্ত নয়। আমরা প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হই, ব্যর্থতার কারণও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। আসলে ব্যর্থতার আশংকা বা ব্যর্থতাকেন্দ্রিক চিন্তাই আমাদের ব্যর্থ করে। চিন্তাটাকে যদি ইতিবাচকভাবে বদলে দেয়া যায়, তাহলেই সৃষ্টি হবে বিপরীত বাস্তবতা। সাফল্য আসবে স্বতস্ফূর্তভাবে।
কিন্তু কীভাবে? প্রক্রিয়া খুব সহজ। তার আগে জানতে হবে আমাদের শক্তির উৎস সম্পর্কে।
১. দৈহিক শক্তি
২. মানসিক শক্তি
দৈহিক শক্তির সীমা আছে, কিন্তু মনের শক্তি অসীম। আমাদের সকল সচেতনতার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মন। দেহের পক্ষে অসম্ভব, এমন প্রতিটি কাজ মন করে যেতে পারে খুব সহজে।
দেহের অবস্থান স্থান-কালে সীমাবদ্ধ হলেও মনকে আবদ্ধ করা যায় না। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যে-কোনো স্তরে মন স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারে। দেহের ক্লান্তি আছে, কিন্তু মনের কোনো ক্লান্তি নেই। দেহ যখন ঘুমে অচেতন থাকে, মন তখনোও থাকে সজাগ, সচেতন।
প্রতিটি মানুষেরই রয়েছে একটি মন। মনকে দেখা বা ধরাছোঁয়া না গেলেও এর শক্তিকে অনুভব করতে কষ্ট হয় না। প্রতিভাবান মানুষেরা মনের এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের কল্যাণে ব্যবহার করেন। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষ মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে এর শক্তিকে কল্যাণকর কাজে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হন।
আসলে মনকে নিয়ন্ত্রণ ও এর শক্তিকে সৃজনশীলভাবে কাজে লাগিয়ে আপাত অলৌকিক শক্তির অধিকারী হওয়া সম্ভব। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই জ্ঞানীরা এই প্রচেষ্টাই চালিয়ে এসেছেন। ফলে উদ্ভব হয়েছে মননিয়ন্ত্রণের নানান প্রক্রিয়া। কেউ তা প্রয়োগ করে আধ্যাত্মিকভাবে অগ্রসর হয়েছেন, কেউ পেয়েছেন বৈষয়িক সাফল্য।
মনকে নিয়ন্ত্রণ করার আগে আমাদের মন সম্পর্কে মৌলিক ধারণা অর্জন করা প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা মনকে ভাগ করেছেন তিন ভাগে।
১. সচেতন মন : মনের যে অংশটি সবসময় সজাগ থাকে সেটাই সচেতন মন। সচেতন মন সবকিছুকেই নিজের ধারণা, যুক্তি ও বিশ্বাসের প্রেক্ষিতে বিচার-বিবেচনা করে।
২. অবচেতন মন : মনের এই অংশটি আমাদের জাগ্রত চেতনা অথবা প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। প্রাপ্ত তথ্য, পরিকল্পনা বা আইডিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ শুরু করে দেয়। প্রভাবটা আপনার জন্যে ভালো না ক্ষতিকর তা সে বিবেচনা করে না।
৩. অচেতন মন : এটি মনের এমন একটি গোপন স্থান, যেখানে আমাদের অনুভূতি, ভাবনা, আকাঙ্খা, স্মৃতি জমা থাকে, অথচ সেখানে আপনি সরাসরি ঢুকতে পারবেন না। অচেতন মনের ক্রিয়াকলাপের ব্যাপারে বিজ্ঞান এখনো অন্ধকারে আছে।
মনকে যদি আপনি আইসবার্গের সাথে তুলনা করেন তাহলে বরফের দৃশ্যমান উপরিভাগের মতো সচেতন মন সমগ্র মনের মাত্র ১০%! পানিতে ডুবে থাকা বাকি ৯০%-এর মতোই হলো অবচেতন ও অচেতন মন।
আমাদের মনোদৈহিক প্রক্রিয়াগুলো পরিচালিত হয় মূলত অবচেতন মনের প্রোগ্রামিং দ্বারা।
যেমন ধরুন, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শ্রমিকেরা দিন পার করলেও তারা দিব্যি সুস্থ থাকেন। অথচ অনেককেই দেখবেন বৃষ্টিতে একটু ভিজলেই জ্বর আসে। কারণ হয়ত শৈশবে মা বা বাবা বলেছিলেন, বৃষ্টিতে ভিজিস না, জ্বর হবে। কথাটা তিনি ভুলে গেছেন, মানে সচেতন মনে এটা আর নেই। কিন্তু অবচেতন মনে তথ্যটা লিপিবদ্ধ হয়ে আছে এবং মনোদৈহিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে। ফলে বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা পানি মাথায় পড়তেই তিনি অসুস্থ হচ্ছেন।
আসলে অবচেতন মন কাজের ফলাফলের কল্যাণ-অকল্যাণ বিচার করে না। বেশিরভাগ মানুষের ব্যর্থতার মূল কারণ এরমধ্যেই নিহিত। কারণ তাদের বেশিরভাগ চিন্তাই ব্যর্থতাকেন্দ্রিক। আর অবচেতন মন সে চিন্তাকেই বাস্তবায়ন করে।
সফল হতে হলে তাই প্রক্রিয়াটিকে উলটে দিতে হবে। অর্থাৎ, সাফল্যের জন্যে আপনি কী চান সে সম্পর্কে অবচেতন মনকে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নির্দেশ পাঠাতে হবে। তাহলেই অবচেতন মন সেই চিন্তা ও নির্দেশকে বাস্তবায়ন করার কাজে নেমে পড়বে।
অবচেতন মনকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন এর তথ্যভাণ্ডার পুনর্বিন্যস্ত করা। মানে যে তথ্যগুলো নেগেটিভ প্রোগ্রামিং তৈরি করে আপনাকে হতাশা ব্যর্থতা অসুস্থতার পথে নিয়ে গেছে, সেটার জায়গায় কল্যাণকর তথ্য দিয়ে পুরনো তথ্য প্রতিস্থাপন করতে হবে। এই কাজটি আপনি সবচেয়ে সুন্দরভাবে করতে পারবেন আলফা লেভেলে।
ব্রেন থেকে প্রতিনিয়ত খুব মৃদু বিদ্যুৎ তরঙ্গ বিকিরিত হয়। বিজ্ঞানীরা একে বলেন, ব্রেন ওয়েভ।
চোখ বন্ধ করে গভীর চিন্তা বা বিশ্রামকালে একটু তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব সৃষ্টি হলে ব্রেনের বৈদ্যুতিক তৎপরতা কমে যায়। এ অবস্থায় ব্রেন ওয়েভের ফ্রিকোয়েন্সি দাঁড়ায় প্রতি সেকেন্ডে ৮-১৩ সাইকেল। একে বলা হয়, আলফা ব্রেন ওয়েভ। এসময় মন থাকে প্রশান্ত, শিথিল। মনের এই অবস্থাকেই বলা হয় আলফা লেভেল বা ধ্যানাবস্থা। মেডিটেশনে আমরা এই লেভেলেই বিরাজ করি এবং ব্রেনকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হই।
ব্যর্থতার নিগড় ভেঙে সাফল্যপানে অগ্রযাত্রায় আপনার প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে ধ্যানাবস্থা। ধ্যান বা মেডিটেশনের মাধ্যমে আপনি দেহমনকে পরিকল্পিতভাবে শিথিল করেই আলফা লেভেল বা ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি করতে পারেন। আর যখন তা করবেন তখন অবচেতন মনের গভীরের শক্তিকে কাজে লাগানোর পথ হবে মুক্ত। আপনি প্রবেশ করতে পারবেন মনের আরো গভীরে। সচেতনভাবেই আপনি তখন অবচেতন মনকে দিতে পারবেন যথাযথ নির্দেশ, কাজে লাগাতে পারবেন সৃজনশীলভাবে।
আসলে শরীর-মনকে শিথিলায়নের মাধ্যমে ব্রেন ওয়েভকে আলফা লেভেলে নিয়ে মনের ধ্যানাবস্থা সৃষ্টিই হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন, মননিয়ন্ত্রণ, মেডিটেশন বা পরিকল্পিত ধ্যানের প্রথম ধাপ। আর এ চর্চার মাধ্যমে লাখো মানুষ পেরেছেন হতাশা নেতিবাচকতা ব্যর্থতা অশান্তি অসুস্থতা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে।
লাখো সফল মানুষের এই পথ অনুসরণ করতে পারেন আপনিও। রোজ দু’বেলা কোয়ান্টাম মেথড উদ্ভাবিত শিথিলায়ন মেডিটেশন অনুশীলন আপনাকে এনে দেবে সেই সুযোগই।
[আর্টিকেলটি কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের “ধ্যানাবস্থা: প্রথম পদক্ষেপ” অধ্যায় থেকে অ্যাডাপ্টেড। পুরো চ্যাপ্টারটি পড়তে বইটি সংগ্রহ করুন অথবা ই-বুক পড়ুন এই লিংকে]