সুস্থতা, প্রশান্তি, সুখ ও প্রাচুর্য অর্জনে কীভাবে কাজে লাগাবেন আপনার সবচেয়ে ‘দামী’ সম্পদকে?

published : ১৫ মে ২০২৫

কোয়ান্টাম মেথড হলো সুস্থতা, সাফল্য ও সুখের ২৮টি সূত্রে গাঁথা একটি টুলবক্স, কম্প্যাক্ট সুইস নাইফের মতোই যা জীবনকে সুন্দর করার জন্যে যে-কোনো সময়, যে-কোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করা যেতে পারে। মেডিটেশনের এত বহুমুখী ব্যবহারের কথা কোয়ান্টাম বলছে প্রায় ৩ দশক ধরে। 

২৯ নভেম্বর ২০২৪ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সর্বসম্মতিক্রমে ২১ ডিসেম্বরকে ঘোষণা করা হয় বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। শারীরিক মানসিক ও আবেগিকভাবে ভালো থাকার জন্যে মেডিটেশন চর্চার গুরুত্বেরই এ এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

এই ঘোষণার আগেই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ২০২৫ সালকে ঘোষণা করে ‘দ্য ইয়ার অব মেডিটেশন’। এরই প্রেক্ষিতে এই সিরিজ আর্টিকেল, যা মূলত কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের আলোচনাগুলোর অ্যাডাপ্টেশন।

 

আপনি কি নিজেকে নিঃস্ব-রিক্ত-সহায়হীন ভাবেন? আপনি কি মনে করেন আপনার সম্পদ বলে কিছুই নেই? 

এই আর্টিকেলে আপনি আপনার এমন এক সম্পদের কথা জানতে পারবেন, যা জন্ম থেকেই আপনার সাথে আছে। যাকে কাজে লাগিয়ে আপনি সফল হতে পারেন, অর্জন করতে পারেন সুস্থতা প্রশান্তি সাফল্য প্রাচুর্য- সবই। তারপরও এর ক্ষমতা সম্পর্কে আপনি হয়ত অসচেতন।,  আর তা হলো আপনার ব্রেন বা মস্তিষ্ক! 

মানবদেহের সবচেয়ে জটিল, রহস্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এই ব্রেন 

মানব অস্তিত্বের সবকিছুই পরিচালিত হয় ব্রেন দ্বারা। ব্রেনকে কাজে লাগিয়েই উদ্ভাবিত হয়েছে মহাকাশ জয়ের কারিগরি নৈপুণ্য, সুপার কম্পিউটারের মতো প্রযুক্তি। 

মানুষ যে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেবা জীব তা এই ব্রেনের কারণেই। বলবেন, হৃৎপিণ্ড ফুসফুস- এগুলোও তো অতীব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ! আসলে সব অঙ্গই গুরুত্বপূর্ণ; তবে এদের চালক হিসেবে ব্রেন একটু বিশেষই! কার্যকারিতার হিসেবে হৃৎপিণ্ড হলো পাম্প মেশিন আর ফুসফুস অক্সিজেন সমৃদ্ধকরণ যন্ত্র। 

ব্রেনের ক্ষমতা দিয়েই আমাদের পূর্বপুরুষরা দৈহিকভাবে বহুগুণ শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাভূত করে শুধু টিকেই থাকে নি, বরং প্রাণিকুলের মাঝে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে। ব্রেনই মানুষকে পাথরের অস্ত্র তৈরি থেকে শুরু করে মহাশূন্যযান বানানো পর্যন্ত সব করতে শিখিয়েছে। মানুষ অতীতে যা করেছে, এখন যা করছে এবং ভবিষ্যতে যা করবে তা এই ব্রেনেরই ফসল।

কী আছে মস্তিষ্কে? 

মানব মস্তিষ্কের গড়পড়তা ওজন দেড় কেজি। অথচ এটুকু জায়গার মধ্যে আছে ১০০ বিলিয়ন নিউরোন এবং ১ ট্রিলিয়ন গ্লিয়াল সেল!

একটি নিউরোন অপর নিউরোনের সাথে সংযুক্ত হয় সূক্ষ্ম তন্তু ডেনড্রাইট ও এক্সনের মাধ্যমে। একটি নিউরোন ১০ হাজার থেকে দুই লক্ষ নিউরোনের সাথে সংযুক্ত। পরস্পর সংযুক্ত দুটো নিউরোনের মধ্যে একটা ফাঁক থাকে, একে বলা হয় সিন্যাপস (Synapse)। মস্তিষ্কে সিন্যাপস-এর সংখ্যা কমপক্ষে ১০০ ট্রিলিয়ন! তাহলেই ভাবুন, মাথার খুলির মধ্যে থাকা এইটুকু একটা অঙ্গ কতটা সূক্ষ্মভাবে তৈরি! 

ব্রেন দুটি বলয়ে বিভক্ত: ডান বলয় ও বাম বলয়। বাম বলয় কথা, যুক্তি এবং বৈষয়িক চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে। আর ডান বলয় কাজ করে কল্পনা, আবেগ এবং সৃজনশীলতাকে কেন্দ্র করে।

ব্রেইনের সেরিবেলাম বা লঘু মস্তিষ্ক আমাদের শরীরের চলাফেরার ভঙ্গি এবং গতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেহের প্রতিটি কাজ সুন্দরভাবে সমন্বয় করে। আর আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, হার্টবিট এবং হজমের মতো ইচ্ছানিরপেক্ষ কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেন স্টেম। 

ব্রেন কীভাবে কাজ করে? 

ব্রেনের কাজ পরিচালিত হয় ইলেকট্রোকেমিক্যাল প্রক্রিয়ায়, যা প্রতিনিয়ত ২০-২৫ ওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। 

ব্রেন এক অসীম ক্ষমতাধর অঙ্গ, যা সুপার কম্পিউটারের চেয়েও বেশি কর্মক্ষম। ব্রেন শুধু তথ্য প্রক্রিয়াকরণই নয়, নিজেকে মেরামতও করতে পারে, যা কম্পিউটার করতে পারে না। এটি সচেতন বা অচেতন অবস্থাতেও সক্রিয় থাকে এবং নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা রাখে। 

মস্তিষ্ক পারিপার্শ্বিকতা থেকে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে তা প্রক্রিয়াজাত করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম করে তোলে। এক লক্ষ নিউরোন মাত্র এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে বিপদ থেকে বাঁচার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়। খাবার মুখে নেয়ার পর লালা নিঃসরণ, খাবার হজম ও পুষ্টি গ্রহণের প্রক্রিয়া ব্রেনের সুচারু সমন্বয়েই ঘটে।

মস্তিষ্ক আর নার্ভাস সিস্টেমের মূল উপাদান নিউরোন। নিউরোন সেল থেকে তারের মতো চারদিকে চলে গিয়েছে অসংখ্য স্নায়ুতন্তু। এসব স্নায়ুতন্তু দিয়ে তথ্য ঘণ্টায় প্রায় ২২৫ মাইল বেগে ভ্রমণ করে ব্রেন থেকে পায়ে পৌঁছাতে সময় নেয় সেকেন্ডের ৫০ ভাগের মাত্র ১ ভাগ! নিউরোন থেকে নিউরোনের তথ্য প্রবাহিত হয় নিউরোট্রান্সমিটার নামে রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে। 

নিউরোট্রান্সমিটারকে তুলনা করা যায় ইনকা সাম্রাজ্যের রানারদের সাথে 

ইনকা সভ্যতা ছিল একটি বিস্তৃত সাম্রাজ্য, যার রাজধানী মাচু পিচ্চু আন্দিজ পর্বতমালার উচ্চতায় অবস্থিত। ইনকাদের রানাররা খালি পায়ে দীর্ঘ পথ দৌড়ে সমস্ত সাম্রাজ্যের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত। ১৫৩২ সালে স্প্যানিশ অভিযাত্রী পিজারোর বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপাকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। এতে পতন ঘটে ইনকা সভ্যতার। 

রানাররা কিন্তু আতাহুয়ালপাকে বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারে আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছিল। তারপরও কেন এই পতন? মূল কারণ প্রস্তুতির অভাব। 

ইনকার রানাররা যেমন পর্বতমালা অতিক্রম করে রাজধানী মাচু পিচ্চুতে বার্তা পৌঁছে দিত, তেমনি নিউরোট্রান্সমিটার ব্রেন ও দেহের মধ্যে তথ্য বহন করে। তারপরও যে দেহ কখনো কখনো রোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় তা আতাহুয়ালপার মতো যথাযথ প্রস্তুতির অভাবের কারণেই।

জীবনে সুস্থতা, সাফল্য ও প্রাচুর্যের জন্যে প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি  

নিউরোট্রান্সমিটার কর্তৃক বাহিত তথ্যই মানুষের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। এই তথ্য বহন সুচারু হবে যদি থাকে যথাযথ মানসিক প্রস্তুতি। সুসংহত মানসিক প্রস্তুতি এবং চিন্তার সৃজনশীল ব্যবহারের সমন্বয় মানুষকে এনে দিতে পারে ঈর্ষণীয় সাফল্য ও সুখ। আর এ-ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে মেডিটেশন। 

আসলে মেডিটেশন মনের জট খুলে দেয়, মনকে স্থির ও সুসংহত করে তোলে। এতে ব্রেনের কার্যক্ষমতা উন্নত হয় এবং ব্রেনের তথ্য প্রবাহ হয় নির্বিঘ্ন। বজায় থাকে দেহ ও মনের ভারসাম্য। ফলে মানুষ তার প্রতিকূলতা মোকাবিলায় সক্ষম হয় এবং অর্জন করে সুস্থতা, প্রশান্তি, সুখ ও সাফল্য।

 

আর্টিকেলটি কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের ‘ব্রেন : বিস্ময়কর জৈব কম্পিউটার’ অধ্যায় থেকে অ্যাডাপ্টেড। পুরো চ্যাপ্টারটি পড়তে বইটি সংগ্রহ করুন অথবা ই-বুক পড়ুন এই লিংকে]