শিথিলায়ন

শুরু করুন শিথিলায়ন দিয়ে

সাফল্য লাভে মনের শক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্যে মনের বাড়িতে যাওয়ার পথ হচ্ছে শিথিলায়ন। একটু প্রস্তুতি ও সহজ অনুশীলনের মাধ্যমেই আপনি তা আয়ত্ত করতে পারবেন। আপনার অনুশীলনের সুবিধার জন্যে আমরা ধাপে ধাপে শিথিলায়নের পর্যায়গুলো আলোচনা করছি।

প্রস্তুতি

শিথিলায়ন অনুশীলনের জন্যে প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে একটি নিরিবিলি ঘর বেছে নিন। নিশ্চিত হোন এ সময় কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না। দরজা ভালোভাবে বন্ধ করে নিন। টেলিফোন অন্য ঘরে রেখে আসুন, অথবা টেলিফোনের আওয়াজ কমিয়ে কাপড় দিয়ে এমনভাবে ঢেকে রাখুন যাতে টেলিফোন বাজলেও তার আওয়াজ আপনাকে হতচকিত করে না দেয়। দরজা বন্ধ করলেও ঘরের ভেতরে যাতে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর ঘর একেবারে অন্ধকার করে ফেলবেন না, হালকা আলো থাকতে হবে। গায়ের পোশাক একটু ঢিলে করে নিন। অনুশীলন শুরুর আগে দুই এক দিনের মধ্যে ঘটেছিল এমন কোনো আনন্দদায়ক ঘটনা বা কোনো সুখানুভূতির কথা চিন্তা করুন। সে ঘটনা যত তুচ্ছই হোক না কেন, কিছু যায় আসে না। অনুভূতিটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

শক্ত বিছানায় অথবা মেঝেতে মাদুর বা পাতলা কার্পেট বিছিয়ে শুয়ে পড়ুন। এভাবে শুতে অসুবিধে হলে মাথার নিচে পাতলা একটি বালিশ দিতে পারেন। তবে বিছানা যত শক্ত হয় ততই ভাল। শোয়ার পর হাত থাকবে দেহের দুপাশে, হাতের তালু থাকবে উপরের দিকে। দুপায়ের মাঝখানে অন্তত চার আঙুল ফাঁক থাকবে।

বসেও আপনি শিথিলায়ন করতে পারেন। মাদুর পেতে বা কার্পেটের ওপর সুখাসন বা পদ্মাসনে বসতে পারেন, অথবা চেয়ারেও আরাম করে সোজা হয়ে বসতে পারেন। পদ্মাসনে বসলে হাতের আঙুল থাকবে হাঁটুর ওপর। আর সুখাসনে বসলে ডান হাত থাকবে বাম হাতের ওপর ঠিক নাভির নিচ বরাবর। চেয়ারে এমনভাবে বসবেন যাতে পায়ের পাতা ও আঙুল মাটি স্পর্শ করে এবং হাতের তালু থাকে হাঁটুর ওপর। মেরুদণ্ড ও ঘাড় থাকবে সোজা।

শিথিলায়ন স্তর

আলফা স্টেশন

আলফা স্টেশন এমন একটি সুন্দর স্থান, যেখানে আছে ঘন বন, ঝর্না, লেক, সুন্দর বাগান ও একটি ওয়েটিং রুম। প্রথম বার মেডিটেশনের সময় আলফা স্টেশনে এগুলো কল্পনায় তৈরি করে নিতে হবে।

মনের বাড়ি

আলফা স্টেশনে পৌঁছে ১৯ থেকে ০ গণনা করে মনের বাড়ি যেতে হবে। ১৯ থেকে ০ গণনা করে আপনি আপনার সবচেয়ে প্রিয় প্রাকৃতিক পরিবেশে চলে যাবেন। এই পরিবেশটুকু আপনি কাল্পনিকভাবেও তৈরি করতে পারেন। একদিকে বাগান, একদিকে পাহাড়, একদিকে নদী, লেক, এক পাশে সমুদ্র। এভাবে আপনার প্রিয় প্রাকৃতিক পরিবেশ দিয়ে মনের বাড়ির পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল কল্পনা করবেন। আপনার সবচেয়ে পছন্দের বাড়িকে মনের বাড়ি বানাবেন। মনের বাড়ির দরবার বেশ বড়সড় হবে।

ডান দিকে একটি বারান্দা দিয়ে বড় আরেকটি কক্ষ আপনার নিরাময় কক্ষ হিসেবে কাজ করবে।

আর দরবারের বামদিকের কোণায় অবস্থিত দরজা দিয়ে ১০ থেকে ০ গণনা করে প্রবেশ করবেন কমান্ড সেন্টারে। এছাড়া আপনার প্রয়োজনে মনের বাড়িতে গবেষণা কক্ষ, রেওয়াজ কক্ষ, অভিনয় কক্ষ, ইবাদত বা প্রার্থনা কক্ষ ইত্যাদি তৈরি করতে পারেন। মনের বাড়িতে যখনই যাবেন তখনই প্রয়োজন অনুসারে কক্ষ সংস্কার, পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারবেন।

অটোসাজেশন

মনে মনে ইতিবাচক শব্দের বারবার উচ্চারণ বা অনুরণনই হচ্ছে অটোসাজেশন।

বার বার ইতিবাচক কথার পুনরাবৃত্তি করে আমরা বহু শারীরিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা পুরোপুরি পরিবর্তন করতে পারি। যেমন :

১. অটোসাজেশনের পুনরাবৃত্তি করে রোগমুক্তি।

২. মানসিক উন্নয়ন ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি এবাং পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়ন।

৩. ইতিবাচক কথা দিয়ে সন্তানদের মেধা, সাহস ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি।

৪. ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক সুযোগ সুবিধা লাভ।

৫. কর্মক্ষেত্রে বসের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন ও বসের আনুকূল্য লাভ।

৬. ছাত্র/ছাত্রীদের শিক্ষক/শিক্ষিকার সাথে ভুল বুঝাবুঝির অবসান ও তাদের কাছ থেকে আনুকূল্য ও মমতা লাভ।

৭. ইতিবাচক কথা ও কল্পনার মাধ্যমে সুন্দর ভবিষ্যত সৃষ্টি।

অটোসাজেশনের শব্দমালা যেমন হতে পারে-

• এই প্রত্যয়ন বা হলফ সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত। তাই ‘আমি বা আমার’ শব্দ ব্যবহার করুন।

• পুরোপুরি ইতিবাচক হোন। যা কামনা করেন তা লিখুন। না-সূচক শব্দগুলো এড়িয়ে চলুন। যেমন, ‘আমি আর ভুলবো না’- এভাবে না বলে বলুন, ‘আমার স্মৃতিশক্তি বাড়বে’ বা ‘প্রয়োজনীয় সবকিছু আমার মনে থাকবে’।

• নেতিবাচক শব্দ পরিহার করুন। করব না, পারব না, চাই না শব্দ পরিহার করুন।

• বর্তমান কাল জ্ঞাপক শব্দ ব্যবহার করুন।

• তুলনা করবেন না। অতীতের সাথে বা অন্যের সাথে তুলনা করবেন না।

• প্রত্যয়ন অবশ্যই বাস্তবসম্মত হতে হবে।

• কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করবেন না। সময়সীমা ক্ষতিকর হতে পারে, এতে টেনশন সৃষ্টি হয়।

অটোসাজেশন স্বাভাবিক জাগ্রত অবস্থায় কিংবা ধ্যানের স্তরে মনের বাড়ির দরবার কক্ষে বসেও দিতে পারেন। যখনই সময় পান, এর পুনরাবৃত্তি করুন। বারবার অটোসাজেশন নিঃসন্দেহে আপনার অবচেতন মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, আত্মনির্মাণে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। আপনাকে মনে রাখতে হবে অবচেতন মনের তথ্য ভাণ্ডার পুনর্বিন্যাস করার জন্যে এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর। প্রোগ্রাম করার পর এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব অবচেতন মনের উপর ছেড়ে দিন। ব্রেনকে তার নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ করতে দিন। আপনি শুধু পাশে দাঁড়িয়ে দেখুন। পরিবর্তন সম্পন্নের জন্যে জোর মানসিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন নেই। কতদূর অগ্রগতি হলো, তা বারবার খতিয়ে দেখতে যাবেন না। ঘটনা ঘটতে দিন। অন্যের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করবেন না। আপনার কি ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে অন্যের কাছে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করবেন না। আপনি চুপচাপ এই টেকনিকের প্রয়োগ ও পুনরাবৃত্তি করে যান। আপনি শিগগিরই পরিবর্তন অনুভব করতে পারবেন অথবা আপনার বন্ধুরাই আপনার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করবে।

মনছবি

মনছবি হচ্ছে ভবিষ্যতের কল্পনা বা স্বপ্ন এবং বিশ্বাস। আসলে কল্পনা বা স্বপ্ন যখন বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয় তখনই তা পরিণত হয় মনছবিতে অর্থাৎ ভবিষ্যতের বাস্তবতায়। এরা কেউ সচেতনভাবে আবার কেউ সহজ স্বতঃস্ফূর্ততায় মনছবি দেখেছেন।

ঔপন্যাসিক কূর্ট ভনেগার্ট চমৎকারভাবে বলেছেন কথাটা, ‘আমরা নিজেদের সম্পর্কে যা কল্পনা করি মনে মনে যে ছবি আঁকি আমরা তা-ই।’ প্রতিনিয়ত আমরা নিজের সম্পর্কে মনের ভেতরে যে ইমেজ তৈরি করছি, মনে মনে নিজের যে ছবি আঁকছি বাস্তব জীবনেও আমরা তাতেই পরিণত হচ্ছি। কারণ আপনি আপনার পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে যা সত্য বলে মনে করছেন, পারিপার্শ্বিকতার যে ছবি মনে মনে আঁকছেন তাতে আপনার অনুভূতি, আচরণ ও কর্মতৎপরতা প্রভাবিত হচ্ছে। ব্রেনের ভাষা হচ্ছে ছবি বা ইমেজ। আমাদের সাফল্যের প্রক্রিয়া সক্রিয় হয় প্রধানত আমাদের কল্পনা দ্বারা। কারণ কল্পনা আমাদের লক্ষ্যের ছবি মনের মুকুরে এঁকে দেয়।

আপনি যা হতে চান তার সুস্পষ্ট ছবি মনের মধ্যে গেঁথে দিন, সবসময় সে ছবি মনে ধরে রাখুন। এ ছবিই আপনার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি পাল্টে দেবে। কারণ আপনি যা সত্য বলে কল্পনা, চিন্তা ও বিশ্বাস করেন, আপনার নার্ভাস সিস্টেম সে ভাবেই প্রতিটি কাজ করবে।

আমাদের প্রাচীন সাধকরা হাজার হাজার বছর আগেই মনছবির গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন এবং আত্ম উন্নয়ন ও মানবতার কল্যাণে তা ব্যবহার করে গেছেন। এখনও সাধকরা মনছবিকে সেভাবেই ব্যবহার করে আসছেন। আত্ম উন্নয়ন ও সাফল্যের হাতিয়ার হিসেবে অবচেতন মনের পুরো শক্তির ব্যবহার করার জন্যে আপনিও মনছবিকে নির্ভুল লক্ষ্যভেদী অস্ত্ররূপে ব্যবহার করতে পারেন।

মনছবিরর কার্যকারিতার ৫টি শর্ত :

১. লক্ষ্য স্থির : লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট হতে হবে।

২. লক্ষ্যের যৌক্তিকতায় পূর্ণ আস্থা থাকতে হবে।

৩. লক্ষ্য অর্জনের অনুভূতি বিকিরণ। দর্শক হিসেবে নয়, মনছবির নায়ক হিসেবে পুরো ছবিকে দেখতে হবে।

৪. মনছবির সাথে সার্বক্ষণিক একাত্মতা অর্জন।

৫. লক্ষ্য অর্জনের জন্যে নীরবে কাজ করা। মনের গহীনে মনছবি স্পষ্টভাবে বসিয়ে দিন। লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে তা দিবানিশি কাজ করবে। প্রয়োজনে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেবে। উৎসাহ উদ্যম ও তাড়না সৃষ্টি করবে। যদি কারো মধ্যে মনছবির লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের তাড়না সৃষ্টি না হয়, তবে বুঝতে হবে তিনি যা করছেন তা মনছবি নয়। তা হচ্ছে আকাশ কুসুম কল্পনা। তিনি তার কল্পনাকে বিশ্বাসে রূপান্তরিত করতে পারেন নি।

এবার শুরু করুন

হালকাভাবে চোখ বন্ধ করুন। ভ্রূ ও চেহারা কুঁচকাবেন না। চোখের দুই পাতাকে ধীরে ধীরে একসাথে লেগে যেতে দিন। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই আপনি কোনো কিছু দেখা থেকে বিরত থাকছেন এবং সবচেয়ে সক্রিয় ইন্দ্রিয় চোখকে বিশ্রাম দেয়ায় কোনো কিছু দেখে উত্তেজিত বা চিন্তাগ্রস্ত হওয়া থেকে রেহাই পাচ্ছেন।

এবার নাক দিয়ে লম্বা দম নিন। আস্তে আস্তে মুখ দিয়ে দম ছাড়ুন। দম নেবেন বিশেষ পদ্ধতিতে। বুক ফুলিয়ে নয়, দম নেয়ার সাথে ধীরে ধীরে আপনার পেটের উপরিভাগ ফুলবে। আবার দম ছাড়ার সময় পেটের উপরিভাগ চুপসে যাবে। দম নেয়া ও ছাড়ার সময় ধীরে ধীরে পেটের উপরের অংশ ওঠানামা করবে। এক, দুই, তিন, এভাবে গুণে গুণে ৬ থেকে ১০ বার দম নিন। দম নেয়ার চেয়ে দম ছাড়তে সামান্য বেশি সময় নিন। দম নিতে নিতে ভাবুন, ‘প্রকৃতি থেকে অফুরন্ত প্রাণশক্তি আমার দেহে প্রবেশ করবে।’ আর দম ছাড়তে ছাড়তে ভাবুন ‘শরীরের সকল দূষিত পদার্থ বাতাসের সাথে বেরিয়ে যাচ্ছে।’ এভাবে ৬ থেকে ১০ বার দম নেয়ার পর দম স্বাভাবিক হতে দিন। অর্থাৎ দম নাক দিয়ে নিয়ে নাক দিয়েই ছাড়তে থাকুন।

আপনার চোখ বন্ধই আছে। এক মুহূর্তে মনের চোখে নজর বুলিয়ে যান, মাথার তালু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত। এবার প্রথম ১০ সেকেন্ড মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করুন মাথার তালুর পেশীগুলোতে। আপনি মনোযোগ দেয়ার সাথে অনুভব করবেন সেখানে রক্ত চলাচল বাড়ছে। সেখানে একটু গরম গরম লাগছে বা একটু শিরশির করছে। এরপর অনুভব করবেন, তালুর পেশী শিথিল হয়ে আসছে। ভারী হয়ে যাচ্ছে। একইভাবে আপনি পর্যায়ক্রমে কপাল, চোখ ও চোখের পাতা, ঠোঁট ও জিহ্বা, চোয়াল, মুখমণ্ডল, গলা, ঘাড়, কাঁধ, ডান হাত, বাম হাত, বুক, পিট, মেরুদণ্ড, পেট, কোমর, নিতম্ব, ঊরু, হাঁটু, পা, গোড়ালি ও পায়ের পাতায় মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করুন। বর্ণিত প্রতিটি অঙ্গে ১০ সেকেণ্ড করে মনোযোগ দিন। মনের চোখ দিয়ে নির্দিষ্ট অঙ্গ অবলোকন করুন। অবলোকনের সাথে সাথে অনুভব করবেন প্রতিটি অঙ্গে রক্ত চলাচল বেড়ে যাচ্ছে। পেশী শিথিল হয়ে ভারি হয়ে আসছে। (অনুশীলন শুরুর আগে কোন্ অঙ্গের পর কোন্ অঙ্গে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করবেন তা কয়েকবার পড়ে মুখস্থ করে ফেলুন। তাহলে অনুশীলনের সময় কোনো অসুবিধা হবে না।) আপনি যখন মাথা থেকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে পায়ের পাতা পর্যন্ত নামতে থাকবেন, তখন অনুভব করুন যে বরফ গলা পানি যেমন বরফের গা বেয়ে নিচের দিকে নামে, তেমনি শিথিলতা স্রোতের মতো আপনার গা বেয়ে মাথা থেকে পায়ের দিকে নেমে যাচ্ছে।

ভাবুন আপনার অঙ্গ শিথিল ও নিষ্প্রাণ হয়ে আসছে। এবার আবার ৫ বার নাক দিয়ে ধীরে ধীরে দম নিয়ে বেশ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে নাক দিয়ে দম ছাড়ুন। দম নেয়ার চেয়ে ছাড়ার জন্যে সময় একটু বেশি নিন। এরপর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হতে দিন।

এবার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করুন দমের ওপর। বাতাস কিভাবে নাক দিয়ে ঢুকছে তা অনুভব ও মনের চোখে অবলোকন করুন। অনুভব ও অবলোকন করুন বাতাস কীভাবে ফুসফুসের প্রতিটি কোষে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে আসছে। দমের আসা-যাওয়ার ওপর আপনার মনোযোগ দিন। বাতাস স্বাভাবিক যাওয়া-আসা করবে, আপনি শুধু দমের প্রতি খেয়াল রাখুন। (১ থেকে ২ মিনিট আপনি দম অবলোকন করুন। এরপর অনুভব করুন আপনার শরীর ভারি লাগতে শুরু করছে।

আপনি এবার সচেতন হোন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে। কীভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আপনার শরীরকে নিচের দিকে টানছে তা অনুভব করুন। নিজের ওজন অনুভব করুন। অনুভব করুন মাথার ওজন। কাঁধ, বুক, নিতম্ব, হাত, পায়ের ওজন বেড়ে গেছে তা খেয়াল করুন। অনুভব করুন তা ভারি হতে হতে জড় পদার্থে পরিণত হচ্ছে। অনুভব করুন দেহের জৈবকোষগুলো আর জৈবকোষ নেই, পরিণত হয়েছে বালুকণায়।

অনুভব করুন আপনার সারা দেহ এখন বালুকণায় পরিণত হয়েছে। এবার অনুভব ও অবলোকন করুন আপনার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ থেকে বালুকণাগুলো ঝরে পড়তে শুরু করেছে। আঙুল, হাত, পা, বুক, পেট, ঊরু সব বালুর মত ঝরে ঝরে পড়ে যাচ্ছে। আপনি পরিণত হচ্ছেন এক বালুর স্তূপে। যত স্পষ্টভাবে সম্ভব কল্পনা করুন যে আপনার পুরো শরীর সূক্ষ্ম বালুকণার স্তূপে রূপান্তরিত হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে।

আপনি এখন সূক্ষ্ম বালুকণার স্তূপ। এখন আপনি অনুভব করুন উত্তর দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। বাতাসের বেগ আস্তে আস্তে বাড়ছে। বাতাস ঝড়ের রূপ নিচ্ছে আর ঝড় আপনার শরীরের অবশিষ্টাংশ হিসেবে যে বালুকণাগুলো রয়েছে তা উড়িয়ে নিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। আপনার শরীর বলতে আর কিছুই নেই। আপনার বলতে এখন রয়েছে শুধু আপনার চেতনা, আপনার মন। আপনি এখন পরিপূর্ণরূপে শিথিল। শিথিলায়নের গভীর স্তরে পৌঁছে গেছেন আপনি। আপনার ব্রেন ফ্রিকোয়েন্সি বিটা স্তর থেকে নেমে গেছে আলফায়। মনের বাড়ির পথে এখন আপনি আলফা স্টেশনে এসে পৌঁছেছেন। এই স্টেশনে আপনার জন্যে রয়েছে বিশেষ ওয়েটিং রুম।

এবার মনে মনে বলুন, আলফা স্টেশনে থেকে এখন আমি আরও গভীরে মনের বাড়িতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। আমি যতক্ষণ মনের বাড়িতে থাকব, ততক্ষণ বাইরের যে-কোনো অপ্রয়োজনীয় শব্দে আমার মনোযোগ আরো গভীর হবে। তবে আগুন, ভূমিকম্প বা কোনো বিপজ্জনক বা জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আমি যত গভীর লেভেলেই থাকি না কেন, মুহূর্তে পুরোপুরি জেগে উঠব এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

আলফা স্টেশন থেকে মনের বাড়িতে প্রবেশের জন্যে এবার বিশেষ কাউন্ট ডাউন শুরু করুন। ১৯ থেকে ০ গণনার পর আপনি আলোর পথ দিয়ে পৌঁছে যাবেন মনের বাড়িতে। ১৯ উচ্চারণের সাথে সাথে আপনি কল্পনায় অবলোকন করুন শীতল নীল স্নিগ্ধ আলো বর্ষিত হচ্ছে আপনার উপর। আলোয় আপনি অবগাহন করছেন। আলোর এক দীর্ঘ পথ রচিত হয়েছে আপনার জন্যে। আর সে পথ পৌঁছে গেছে মনের গভীর স্তরে। আপনি ১৮, ১৭, ১৬, ১৫, ১৪, ১৩, ১২, ১১ উচ্চারণ করুন। এবার মনে মনে বলুন, ‘আলোর পথ দিয়ে আমি পৌঁছে যাচ্ছি মনের গভীর থেকে গভীরে।’ আবার ১০, ৯, ৮, ৭, ৬। মনে মনে বলুন, ‘গভীর থেকে গভীরে পৌঁছে যাচ্ছি আমি।’ ৫, ৪, ৩, ২, ১, ০ উচ্চারণ করুন। মনে মনে বলুন, ‘আমি পৌঁছে গেছি মনের বাড়িতে।’ আর অনুভব করুন এক অনাবিল প্রশান্তি।

মনের বাড়িতে পৌঁছার পর আপনি প্রথমে পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী উপভোগ করুন। ফুলের সুবাস, পাতার রং, পাখির কলতান, ঝর্নার শব্দ বা সমুদ্রের তরঙ্গ, আকাশে মেঘের ভেলা, যা যা দেখতে পান সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখুন, স্পর্শ করুন, অনুভব করুন।

এবার মনের বাড়ির ড্রইং রুমে আরাম করে বসুন।

মনের বাড়ি চেতনার এক শক্তিশালী স্তর। এ স্তরে পৌঁছার সাথে সাথে মন দেহের প্রতিরক্ষা ও নিরাময় ব্যবস্থাকে স্বয়ংক্রিয় রোগমুক্তির কাজে নিয়োজিত করে। এ স্তরে মন যে-কোনো কল্যাণমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্রেনকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে। মনের বাড়িতে আপনার যে-কোনো ‘অটোসাজেশন’ মস্তিষ্ক সহজেই গ্রহণ করে। এবার ভবিষ্যতের কার্যক্রমের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করুন। মনে মনে বা জোরে জোরে বলুন, ‘ভবিষ্যতে শিথিলায়নের উদ্দেশ্যে যখনই আমি চোখ বন্ধ করে আরাম! আরাম! আরাম! উচ্চারণ করব তখনই আমার দেহ-মনের সকল অপ্রয়োজনীয় তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে এবং আমি পরিপূর্ণ শিথিল হয়ে যাব। যখনই এরপর ১৯ থেকে ০ গণনা করব তখনই মনের বাড়িতে পৌঁছে যাব।’ এরপর মনকে আরও কিছু ইতিবাচক অটোসাজেশন দিতে পারেন। যেমন, মনে মনে বলতে পারেন, ‘এখন থেকে আমার স্মৃতিশক্তি বাড়বে। আত্মবিশ্বাস ও সাহস বাড়বে। আমার মনোযোগ বাড়বে। আমার শরীর ও মন সবসময় সুস্থ থাকবে। অমূলক ভয়ভীতি ও নেতিবাচক চিন্তা বা নেতিবাচক কথার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া থেকে আমার মন ও মস্তিষ্ক পুরোপুরি মুক্ত থাকবে। ইতিবাচক চিন্তা আমার জন্যে কল্যাণ বয়ে আনবে। আমি যা চাই ইতিবাচক চিন্তা দিয়ে তা পাব। প্রতিদিন আমি সবদিক দিয়ে ভালো হচ্ছি, লাভবান হচ্ছি, সফল হচ্ছি।’

অটোসাজেশনের ক্ষেত্রে আপনি আপনার মনোদৈহিক বা পারিপার্শ্বিক প্রয়োজন অনুসারে যে-কোনো ইতিবাচক কথা সংযোজন করতে পারেন। আপনার উচ্চারিত প্রতিটি অক্ষরই এখন শক্তিতে পরিণত হবে।

এরপর আপনি সময় নিয়ে মনছবি বা অন্যান্য যা করার প্রয়োজন তা করতে পারেন।

এবার জেগে ওঠার পালা। আপনাকে এখন মনের বাড়ি থেকে বাস্তবে ফিরে আসতে হবে। প্রথমে লম্বা দম নিন। মনে মনে বা আওয়াজ করে বলুন, ‘০ থেকে ৭ গুণে আমি চোখ মেলে তাকাব, আমি পুরোপুরি জেগে উঠব, পূর্ণ সচেতন অবস্থায় শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি চাঙ্গা হয়ে উঠব।’ এবার গণনা শুরু করুন। ০, ১। অনুভব করুন উড়ে যাওয়া বালুকণাগুলো চারপাশ থেকে এসে আপনার শরীর গঠন করছে। ২, ৩। লম্বা দম নিন। অনুভব করুন বালুকণাগুলো প্রাণবন্ত জৈবকোষে পরিণত হয়েছে। ৪, ৫। আবার লম্বা দম নিন। মনে মনে বলুন, ‘৭ গুণে আমি চোখ মেলে তাকাব, আমি পুরোপুরি জেগে উঠব, আমার মাথা, ঘাড়, কাঁধ বা শরীরে কোনো ব্যথা বা অস্বস্তি থাকবে না। পূর্ণ সচেতন অবস্থায় শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ, সবল ও চাঙ্গা অনুভব করব।’ ৬, ৭। এবার চোখ মেলুন। মাথা ও ঘাড় নাড়ুন। পা টান টান করুন। হাত নাড়ুন। আস্তে আস্তে উঠে বসুন বা দাঁড়ান। জোরে বলুন, ‘বেশ ভালো লাগছে। শরীর মন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।’

আপনার করণীয়

যারা অনিদ্রায় ভোগেন, তারা খুব প্রফুল্লচিত্তে রাতে শোয়ার আগে এই শিথিলায়ন করতে পারেন, ঘুমের ট্যাবলেট ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়বেন। কেউ কেউ আবার অন্য সময়েও এই শিথিলায়ন করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। ঘুম ঘুম ভাব এলে অনুশীলনীর যতটুকু করার পর ঘুম এসেছিল, সেখান থেকে পুনরায় শুরু করুন। আর যদি শুয়ে করতে গেলেই ঘুম চলে আসতে চায় তাহলে চেয়ারে বসে বা মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে আরাম করে বসে শিথিলায়ন করুন। কেউ কেউ এই শিথিলায়ন করতে গিয়ে বসে বসেও ঝিমাতে পারেন, মুহূর্তে তন্দ্রায় চলে যেতে পারেন, তাদের সচেতন প্রচেষ্টায় ঘুম এড়িয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে আপনি ঘুমের অনুশীলন করছেন না, আপনি শিথিলায়ন করছেন মন নিয়ন্ত্রণের জন্যে। ঘুমিয়ে পড়লে আরাম পাবেন ঠিকই কিন্তু শিথিলায়নের আসল উপকারিতা থেকে বঞ্চিত হবেন, সেই সাথে মন নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া এবং অতীন্দ্রিয় শক্তি লাভ হবে বিলম্বিত।

নিয়মিত শিথিলায়ন করে গেলে আপনার শরীর মন আপনার সঙ্কেতের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেবে (Condition reflex response)| পরিশেষে দেখবেন শিথিল হওয়ার জন্যে এত লম্বা নিয়ম পালন করার প্রয়োজনই হচ্ছে না। শুধু চোখ বন্ধ করে কয়েকবার লম্বা দম নিয়ে এবং ১/২ মিনিট দম অবলোকন করে ‘আরাম’ ‘আরাম’ উচ্চারণের সাথে সাথে আপনার দেহ-মনের সকল অপ্রয়োজনীয় তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে, আপনি পরিপূর্ণরূপে শিথিল হয়ে যাবেন এবং ১৯ থেকে ০ গণনার সাথে সাথে মনের গভীর স্তরে মনের বাড়িতে পৌঁছে যাবেন। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত শরীর-মন আপনার সঙ্কেতের সাথে সম্পৃক্ত না হচ্ছে ততক্ষণ ধৈর্য ধরে প্রতিটি ধাপ অনুসরণ করে শিথিলায়ন করে যান।

[মনোশক্তি ব্যবহারের পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলোকে ফলপ্রসূভাবে প্রয়োগ করার জন্যে আপনার প্রথম এই শিথিলায়ন রপ্ত করতে হবে। এজন্যে নিয়মিত দিনে ২ বার করে ৪০ দিন চর্চার কর্মসূচী নিন। কারণ মেডিটেশন লেভেলে পৌঁছতে পারলেই এর পরবর্তী টেকনিকগুলো সাফল্যের সাথে প্রয়োগ করতে পারবেন। বিস্তারিত নিরীক্ষায় দেখা গেছে, নিজে নিজে এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করে যে-কোনো বয়সের নর-নারী শিথিলায়ন করতে পারেন। কেউ ১০/১৫ দিনের মধ্যেই শিথিলায়ন রপ্ত করে ফেলতে পারেন, কারো হয়তো বা নিজে নিজে রপ্ত করতে নিয়মিত ২/৩ মাস চর্চার প্রয়োজন হতে পারে।]

স্মরণ রাখুন

শিথিলায়নের এই ধাপগুলো দেখে সব মুখস্থ করে অথবা ওয়েবসাইট থেকে ফাইল ডাউনলোড করে শুনুন। আপনাকে যা বলা হয়েছে তা শুধু কল্পনা করে যাবেন। যে রকম বলা হচ্ছে ঠিক সে রকম অবলোকন বা অনুভব করতে পারলেন কি পারলেন না, তা নিয়ে ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনাকে যেভাবে অবলোকন বা অনুভব করতে বলা হয়েছে, আপনি ভাববেন বা কল্পনা করবেন যে, আপনি সে রকম অনুভব করছেন। [ঠিক ছোট বেলায় পুতুলের বিয়েতে খুব মজা করে উপাদেয় খাবার খাচ্ছেন বলে যে রকম ভান বা অভিনয় করতেন সেরকম ভান বা অভিনয় করবেন।] তাহলেই চমৎকার শিথিলায়ন হবে।

প্রথমদিকের মেডিটেশনের অনুভূতি

১. মেডিটেশন শেষে মনে হতে পারে আপনি শুধুমাত্র চোখ বন্ধ করে বসে বা শুয়ে ছিলেন। আর কিছুই অনুভব করেন নি। এমন হলেও চিন্তার কিছু নেই। নিয়মিত করে যান। অনুভূতি আসতে থাকবে।

২. কারো শরীর বেশ ভারী লাগতে পারে। এটা শুভ লক্ষণ। আপনার শরীর খুব দ্রুত কথা শুনতে শুরু করেছে।

৩. কারো গরম লাগতে বা শরীর ঘেমে যেতে পারে। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কয়েকদিন চর্চা করলেই গরম ও ঘাম স্বভাবিক হয়ে আসবে।

৪. কারো মুখে বেশ লালা আসতে পারে। এটাও শুভ লক্ষণ। শরীর প্রথমেই বেশি শিথিল হচ্ছে।

৫. কারো গলা শুকিয়ে যেতে পারে। এমন হলে মনের বাড়িতে থেকেই তেঁতুল বা লেবুর কথা একটু ভাবলেই লালা এসে গলা ভিজিয়ে দেবে।

৬. বসে শিথিলায়ন করলে প্রথম প্রথম প্রায় সবারই ঘাড়ে, কাঁধে বা পিঠে ব্যথা করে। কয়েকদিন নিয়মিত চর্চা করলে এ ব্যথা এমনিতেই দূর হয়ে যায়।

৭. দু/ এক জনের শিথিলায়নকালে মাথা ঘোরা ও বমি বমি ভাব হতে পারে। এমন হলে শিথিলায়নরত অবস্থায়ই লম্বা করে দুই/ তিন বার নাক দিয়ে দম নিয়ে ধীরে ধীরে নাক দিয়ে দম ছাড়ুন। দেখবেন বমি বমি ভাব বা মাথা ঘোরা ভাব চলে যাবে।