দুর্দশার কারণ ‘মাইন্ড ভাইরাস’ : বিনাশ করবেন কীভাবে?

published : ১৭ জুলাই ২০২৫

কোয়ান্টাম মেথড হলো সুস্থতা, সাফল্য ও সুখের ২৮টি সূত্রে গাঁথা একটি টুলবক্স, কম্প্যাক্ট সুইস নাইফের মতোই যা জীবনকে সুন্দর করার জন্যে যে-কোনো সময়, যে-কোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করা যেতে পারে। মেডিটেশনের এত বহুমুখী ব্যবহারের কথা কোয়ান্টাম বলছে প্রায় ৩ দশক ধরে। 

২৯ নভেম্বর ২০২৪ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সর্বসম্মতিক্রমে ২১ ডিসেম্বরকে ঘোষণা করা হয় বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। শারীরিক মানসিক ও আবেগিকভাবে ভালো থাকার জন্যে মেডিটেশন চর্চার গুরুত্বেরই এ এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

এই ঘোষণার আগেই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ২০২৫ সালকে ঘোষণা করে ‘দ্য ইয়ার অব মেডিটেশন’। এরই প্রেক্ষিতে এই সিরিজ আর্টিকেল, যা মূলত কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের আলোচনাগুলোর অ্যাডাপ্টেশন। 

……………………………………………………………………………………………………

‘মাইন্ড ভাইরাস’ কী?

দৃষ্টিভঙ্গি, নিয়ত বা প্রোগ্রাম মনকে নিয়ন্ত্রিণ করে মস্তিষ্ককে পরিচালিত করে। মস্তিষ্কের কাজের ফলাফলও নিরূপিত হয় দৃষ্টিভঙ্গি বা প্রোগ্রাম দ্বারা। এই প্রোগ্রাম দুই ধরনের- আত্মবিনাশী ও আত্মবিকাশী। 

আত্মবিনাশী প্রোগ্রাম হলো রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, দুঃখ, কুচিন্তা, দুশ্চিন্তা, হতাশা, নেতিবাচকতা ইত্যাদি নেতিবাচক আবেগ। বিজ্ঞানীরা এগুলোকেই বলছেন ‘মাইন্ড ভাইরাস’। একজন মানুষকে ধীরে ধীরে অবক্ষয় ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় এই ভাইরাস।    

তাই বিনাশ করুন আপনার মাইন্ড ভাইরাসকে  

আমাদের অধিকাংশের চিন্তা-জগতের শতকরা ৭০-৮০ ভাগই দখল করে রাখে ক্ষতিকর চিন্তা। আমরা যদি এই প্রক্রিয়াকে উল্টে দিতে পারি, অর্থাৎ ৭০-৮০ ভাগ ক্ষতিকর চিন্তাকে ইতিবাচক চিন্তায় পরিণত করতে পারি, তাহলেই আমরা মনের শক্তিকে ফলপ্রসূভাবে কাজে লাগাতে পারব।  

এরপরও যদি নেতিবাচক আবেগ কিছু অবশিষ্ট থাকে, তার প্রভাব এতই হ্রাস পাবে যে, তা ইতিবাচক চিন্তার প্রাধান্যের কারণে আপনার ক্ষতি করতে পারবে না।

তবে আত্মবিনাশী চিন্তার বিনাশ সাধন প্রথমে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। এমনকি নেতিবাচক ও ইতিবাচক চিন্তার অনুপাত ৫০:৫০ করাও মনে হতে পারে দুঃসাধ্য। কারণ আমরা নেতিবাচক চিন্তায় এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, এটা আমাদের চরিত্রের অঙ্গে পরিণত হয়েছে। তবুও একটু সচেতন প্রচেষ্টা চালালে ধাপে ধাপে আপনি এই নেতিবাচক চিন্তাকে নির্মূল করতে পারবেন। 

মাইন্ড ভাইরাস নির্মূলে করণীয় 

১. নেতিবাচক চিন্তাকে সময় দিন সর্বোচ্চ মাত্র পাঁচ মিনিট!  

বিষণ্নতা বা হতাশায় আক্রান্ত হয়েছেন? সব আজেবাজে চিন্তা মাথায় ভিড় জমাচ্ছে? ভেতরে ক্ষোভ, ঘৃণা বা প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে? ব্যর্থতার গ্লানিতে ভুগছেন? অনুশোচনা আপনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে? 

ঠিক আছে, ঘাবড়াবার কিছু নেই। হতাশায় তলিয়ে যান। কিন্তু সময় পাচ্ছেন ঘড়ি ধরে মাত্র পাঁচ মিনিট! পাঁচ মিনিট পর্যন্ত যত নেতিবাচক চিন্তা করতে পারেন করুন। 

তারপরই নেতিবাচক চিন্তা বন্ধ করে দিন। ক্রমান্বয়ে সময় কমাতে থাকুন। চার মিনিট, কিছুদিন পর তিন মিনিট। তারপর দুই মিনিট। 

তারপর এমন সময় আসবে যখন বিষণ্নতা বা দুশ্চিন্তা আসার সাথে সাথেই ইতিবাচক মনোভাব দিয়ে তাকে অকেজো বা নিউট্রালাইজ করে দিতে পারবেন। 

২. চিন্তার চ্যানেল পাল্টে দিন!

রেডিও-টিভির চ্যানেল পাল্টানোর সাথে সাথে যেমন ভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়, তেমনই নেতিবাচক বা ক্ষতিকর ভাবনা আসতে শুরু করলেই ভাবনার গতিপথ পালটে দিন।  

ঘরে বসে থাকলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। দেখুন না বাইরে কী হচ্ছে! আপনার জানালার ধারে কি কোনো গাছ আছে? গাছে কি কোনো কাঠঠোকরা গর্ত করার চেষ্টা করছে? কোনো টুনটুনি দম্পতি কি পিঠা তৈরির ব্যাপারে শলা-পরামর্শ করছে? বা কোনো পাখি কি নীড়ে ফিরে বাচ্চাদের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে? এর যে-কোনো একটির দিকে মনোযোগ দিন। 

বাইরে থাকলে তাকান চারপাশে। প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকান, পোশাকের দিকে তাকান, এমন কাউকে অবশ্যই পেয়ে যাবেন, যার অবস্থা আপনার চেয়েও করুণ। 

৩. চিন্তা ও অনুভূতি প্রকাশ করুন

বিশিষ্ট মার্কিন শল্য চিকিৎসক ও রোগ নিরাময়ে মনোশক্তি ব্যবহারের প্রবক্তা ড. বার্নি সীগেল বলেছেন, 'অপ্রীতিকর অনুভূতিসহ আপনার অনুভূতিগুলো পুরোপুরি প্রকাশ করে ফেলা উচিৎ। প্রকাশিত হলেই আপনার ওপর এগুলোর প্রভাব নষ্ট হয়ে যায়।'

সাধারণত আমরা নেতিবাচক চিন্তা বা কুচিন্তার শতকরা ৯০ ভাগ কখনো প্রকাশ করতে পারি না। কারণ একটাই- 'লোকে শুনলে কী বলবে!' অথচ চিন্তার প্রকাশ মনকে হালকা করে। প্রকাশ যত তীব্র হয়, মন তত দ্রুত হালকা হয়ে ওঠে। 

যেমন, দুঃখ পেলে কেউ যদি আর্তচিৎকার দিয়ে কাঁদতে পারেন, তাহলে তিনি সহজে সে দুঃখ কাটিয়ে উঠতে পারবেন। আর যিনি কাঁদতে পারেন না, তিনি সহজে দুঃখ ভুলতে পারেন না।

৪. ভাবনাগুলো লিখুন

ভাবনাগুলোকে যদি মুখে প্রকাশ করতে না পারেন তাহলে সেগুলোকে লিখে কাগজ পুড়িয়ে ফেলুন।  

একটা নীরব কক্ষে বসে লেখা শুরু করুন। আপনার অশান্তি, দুঃখ, ক্ষোভ, অপরাধবোধ, ঘৃণা, হতাশা, ঈর্ষা, লোভ ও লালসা- যা মনে আসে সব লিখুন। কাউকে অশ্লীল গালিগালাজ করতে ইচ্ছে হয়ে থাকলে তা-ও লিখে ফেলুন। যৌন কল্পনা বা অনাচারের কথা, যা কাউকে কখনো বলতে পারেন নি, সেসবও লিখে যান অবলীলায়। 

৫ মিনিট, ১০ মিনিট, আধা ঘণ্টা, ১ ঘণ্টা, ২ ঘণ্টা... ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত লিখুন।  

লেখার সাথে সাথে আপনার ক্ষতিকর চিন্তাগুলো পরিণত হয়েছে কতগুলো লিখিত অক্ষরে। এবার এতক্ষণ যা লিখেছেন সেই কাগজগুলো টুকরো টুকরো করে একটি টিনের কৌটায় রেখে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলুন। কাগজের লেখাগুলো পোড়ার সাথে সাথে অনুভব করুন আপনার সকল ক্ষতিকর চিন্তাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

তবে খেয়াল রাখবেন, কী লিখছেন লিখে ফেলার পর তা কখনোই পড়তে যাবেন না। লেখা ঠিক হোক বা না হোক, যা লিখেছেন সেটাই থাকুক। যদি আপনি লেখাগুলো পড়েন তাহলে আপনার পুরো শ্রমই হবে পণ্ডশ্রম। কারণ যা আপনি মন থেকে বের করে দিতে চাচ্ছিলেন তা পুনরায় চোখের মাধ্যমে মস্তিষ্কে গিয়ে আশ্রয় নেবে।

এভাবে টানা কিছুদিন চর্চা করলে দেখবেন আপনার নেতিবাচক আবেগগুলো কমতে শুরু করেছে।  

[আর্টিকেলটি কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের ‘আত্মবিনাশী প্রোগ্রাম-১- মনের বিষ’অধ্যায় থেকে অ্যাডাপ্টেড। পুরো চ্যাপ্টারটি পড়তে বইটি সংগ্রহ করুন অথবা ই-বুক পড়ুন এই লিংকে]