নিজের সক্ষমতার ওপর অটল বিশ্বাস আপনাকে করবে সুস্থ সফল প্রাচুর্যবান

published : ৮ মে ২০২৫

কোয়ান্টাম মেথড হলো সুস্থতা, সাফল্য ও সুখের ২৮টি সূত্রে গাঁথা একটি টুলবক্স, কম্প্যাক্ট সুইস নাইফের মতোই যা জীবনকে সুন্দর করার জন্যে যে-কোনো সময়, যে-কোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করা যেতে পারে। মেডিটেশনের এত বহুমুখী ব্যবহারের কথা কোয়ান্টাম বলছে প্রায় ৩ দশক ধরে। 

২৯ নভেম্বর ২০২৪ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সর্বসম্মতিক্রমে ২১ ডিসেম্বরকে ঘোষণা করা হয় বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। শারীরিক মানসিক ও আবেগিকভাবে ভালো থাকার জন্যে মেডিটেশন চর্চার গুরুত্বেরই এ এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

এই ঘোষণার আগেই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ২০২৫ সালকে ঘোষণা করে ‘দ্য ইয়ার অব মেডিটেশন’। এরই প্রেক্ষিতে এই সিরিজ আর্টিকেল, যা মূলত কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের আলোচনাগুলোর অ্যাডাপ্টেশন। 

মনের অসীম শক্তিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়?

আমরা জানি মনের শক্তি অসীম। আজ পর্যন্ত মানুষ যা কিছু আবিষ্কার করেছে, জৈবিক শক্তিকে অতিক্রমে যা-কিছু করেছে তার সবকিছুই হয়েছে মনের শক্তিকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে। মনের এই অসীম শক্তিকে কাজে লাগাতে হলে প্রথমত প্রয়োজন এই শক্তির ওপর বিশ্বাস, অর্থাৎ আত্মবিশ্বাস। 

‘আমি পারি, আমি পারব’- এই বিশ্বাস যে সাফল্যের জন্যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যুগে যুগে নিজের শক্তির ওপর বিশ্বাসই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আমি পারব- এই দৃঢ় বিশ্বাসই সকল সাফল্যের ভিত্তি। পারব বলে বিশ্বাস করলে আপনি অবশ্যই পারবেন। 

রজার ব্যানিস্টারের ‘The Mile Run’-ই এই কথার সার্থক প্রমাণ! 

‘The Mile Run’ বা ‘Four-Minute Mile’ হলো ৪ মিনিটে ১ মাইল দৌড় প্রতিযোগিতা। হাজার বছর ধরে দৌড়বিদরা ৪ মিনিটে ১ মাইল দৌড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে জানিয়েছিলেন যে, এটা অসম্ভব! বিশেষজ্ঞরা এর জন্যে দায়ী করলেন মানুষের হাড়ের কাঠামো ও ফুসফুসের গঠনকে। 

৬ মে ১৯৫৪, ব্রিটিশ অ্যাথলেট রজার গিলবার্ট ব্যানিস্টার ৩ মিনিট ৫৯.৪ সেকেন্ডে ১ মাইল দৌড় সম্পন্ন করে বিশ্বব্যাপী হৈচৈ ফেলে দেন। তবে আসল বিস্ময় ঘটে এরপর। ২১ জুন ১৯৫৪, অর্থাৎ মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে ব্যানিস্টারের রেকর্ড ভেঙে অস্ট্রেলিয়ান দৌড়বিদ জন ল্যান্ডি ১ মাইল দৌড়ান ৩ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডে। 

আর ১৯৯৯ সালে নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়লেন মরক্কোর দৌড়বিদ হিশাম আল গুয়েরুজ (Hicham El Guerrouj); তিনি ১ মাইল দৌড়েছেন ৪ মিনিটেরও ১৭ সেকেন্ড কম সময়ে (৩ মিনিট ৪৩.১৩ সেকেন্ড)! এখন পর্যন্ত ১,৭৫৫ জন দৌড়বিদ ৪ মিনিটের কম সময়ে ১ মাইল দৌড়েছেন। 

প্রশ্ন হলো, শত শত বছর ধরে ৪ মিনিটের কম সময়ে কেউই ১ মাইল দৌড়াতে পারলেন না, অথচ রজার ব্যানিস্টারের পর ৭০ বছরে এতজন পারলেন- এটা কীভাবে সম্ভব হলো?

এককথায় উত্তর হলো, বিশ্বাসের শক্তিতে। কাজটা যখন অসম্ভব মনে করা হতো, তখন কেউই পারেন নি। রজার ব্যানিস্টার বিশ্বাস করেছেন পারবেন; তিনি পেরেছেন। আর তাকে দেখে অন্যান্য দৌড়বিদেরাও বিশ্বাস করতে পেরেছেন যে তারাও এটা পারবেন। আর ‘পারি’ বলে বিশ্বাস করলে তো পারা-ই যায়!   

সাফল্যের মূল হলো আত্মবিশ্বাস 

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ' মাত্র পাঁচ বছর স্কুলে লেখাপড়া করতে পেরেছেন। দারিদ্র্যের কারণে ১৫ বছর বয়সে মাসে মাত্র ৪০ টাকা বেতনে কেরানির কাজ নেন। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন একদিন তিনি বড় লেখক হবেন। তাই তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে লিখতেন।  

লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে বার্নার্ড শ'র লেগেছিল ৯ বছর। এই ৯ বছরে তার লেখা থেকে আয় হয়েছিল মাত্র ৩০০ টাকা। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন নি। তার বিশ্বাসই তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। লেখক হিসেবে পরবর্তী সময়ে তিনি উপার্জন করেছেন লাখ লাখ টাকা, হয়েছেন সফল স্মরণীয় বরণীয়।

বিশ্বাসে কি প্রাচুর্য মেলে?  

জ্বি মেলে! এরও আছে দৃষ্টান্ত।

১৮৪৭ সালের এক দিন। ১২ বছরের এক স্কটিশ বালক পিটেনক্রিফ (Pittencrieff) পার্কে ঢুকতে যাচ্ছিল। স্কটল্যান্ডের ডানফার্মলিনের (Dunfermline) এই পার্কটি তখন প্রাইভেট এস্টেট হলেও সপ্তাহে একদিন সবার জন্যে উন্মুক্ত থাকত। উন্মুক্ত দিনটিতেও সেই বালককে পার্কের দারোয়ান ঢুকতে দেয় নি তার নোংরা-মলিন পোশাকের জন্যে। আসলে বালকটি ছিল বস্তির ছেলে। মর্মাহত বালকটি সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল একদিন সে ধনী হয়ে পার্কটিকে কিনে নেবে।

কেটে গেল ৩ দশক। সেই বালকটি অল্প বয়স থেকে বিভিন্ন ব্যবসা ও বিনিয়োগে একের পর এক সাফল্য পেয়ে পরিণত হলো দেশের সেরা ধনীতে। এবং সত্যি সত্যিই পার্কটি কিনে নিল সে। পার্কে লাগানো হলো নতুন সাইনবোর্ড- আজ থেকে দিনে বা রাতে যে-কোনো সময়ে যে-কোনো মানুষ যে-কোনো পোশাকে এই পার্কে প্রবেশ করতে পারবে।

ঘটনাটি আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ধনী স্কটিশ-মার্কিন এন্ড্রু কার্নেগির। যিনি বিশ্বাসের শক্তিকে জয় করেছিলেন দারিদ্র, হয়েছিলেন তার সময়ের শীর্ষ প্রাচুর্যবান। 

বিশ্বাসে হয় রোগ নিরাময়

প্লাসিবো (Placebo) ইফেক্ট শব্দটির সাথে হয়ত আপনার পরিচয় আছে। এর মূল কথা হলো, নিরাময়ের ব্যাপারে ইতিবাচক বিশ্বাস ঘটায় রোগমুক্তি। ওষুধের পরিবর্তে এমনকি সুগার পিল খেয়েও নিরাময় হতে পারে যদি রোগী বিশ্বাস করতে পারেন যে এটাই যথাযথ ওষুধ এবং এটা সেবন করে তিনি সুস্থ হবেন। 

প্লাসিবো ইফেক্টের কার্যকারিতা নিয়ে হয়েছে অজস্র গবেষণা। বিভিন্ন রকম ব্যথা-বেদনা, হজমযন্ত্রের গোলযোগ, আইবিএস ইত্যাদি জটিলতায় প্লাসিবো দারুণভাবে কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে। 

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের প্রফেসর টেড কেপচাক আইবিএস রোগীদের নিয়ে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখান, প্রচলিত পদ্ধতিতে চিকিৎসায় এদের ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায় ৪০ শতাংশ। আর এর সাথে প্লাসিবো যোগ করে রোগীর সমস্যামুক্তি ঘটেছে ৬০ শতাংশ। তিনি বলেন, সবচেয়ে ভালো ওষুধের কার্যকারিতাও এর চেয়ে বেশি কিছু নয়! অথচ তা নিরাপদ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত।  

বিশ্বাস, না আশা- কোনটা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে?   

মানুষ আশা নিয়ে বাঁচে, জীবনে বড় কিছুর আশা করে। কিন্তু বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, ঘাতপ্রতিঘাত এসে আশাকে বদলে দিতে পারে হতাশায়। অতএব শুধু আশা নিয়ে আপনি বেশিদূর এগোতে পারবেন না, যদি না থাকে বিশ্বাস। অন্যদিকে, অটুট বিশ্বাস আপনাকে প্রাথমিক ব্যর্থতায় হতাশ না হয়ে নতুন উদ্যমে জীবন শুরুর প্রেরণা যোগাবে, এনে দেবে অধরা সাফল্য।

আসলে ঘাড়ের ওপর কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকা দামের মস্তিষ্ক নিয়েও যদি আপনি ব্যর্থতার বদ্ধ ডোবায় হাবুডুবু খান তাহলে বুঝতে হবে ঘাটতি আছে আপনার বিশ্বাসে! এই বিশ্বাস নিজের সম্ভাবনার ওপর, সক্ষমতার ওপর। 

তাই সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হিসেবে নিজের সম্ভাবনার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করুন, অটুট বিশ্বাস নিয়ে কাজ করে যান। আপনি হবেন সফল স্মরণীয় বরণীয়।  

 

[আর্টিকেলটি কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের ‘চাবিকাঠি : বিশ্বাস’ অধ্যায় থেকে অ্যাডাপ্টেড। পুরো চ্যাপ্টারটি পড়তে বইটি সংগ্রহ করুন অথবা ই-বুক পড়ুন এই লিংকে]