আমি বদলালেই বদলে যাবে দেশ!

মাহাদী রহমান বাসের জন্যে অপেক্ষা করছে। দেরি দেখে ভাবল বাথরুম সেরে নেবে। পাবলিক টয়লেটে ঢুকতেই তার মেজাজটা সপ্তমে উঠল। ব্যবহার-অযোগ্য নোংরা টয়লেট; যেহেতু নিজের না তাই ব্যবহার শেষে ফ্ল্যাশ করে না কেউ। “মানুষের কমনসেন্স বলতে কিছু নেই” ভাবতে ভাবতে কোনোমতে বাথরুম সেরেই মাহাদী বেরিয়ে গেল কমোডে পর্যাপ্ত পানি না ঢেলেই।

বাস এসেছে; মাহাদী “বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার কোনো নিয়মকানুন নেই” বলে গজ গজ করতে করতে কাউন্টার থেকে টিকেট কাটল কিউ ছাড়াই। অথচ নিয়ম হলো লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কাটা।

মাহাদী বাসে উঠে সিটে বসেই স্মার্টফোন অন করল। অনলাইন নিউজ পোর্টালের একটা লেখা নজর কাড়ল তার- এক জাপানি শিশু তার পোষা কুকুর নিয়ে রাস্তায় হাঁটছিল। কুকুরটা পথে টয়লেট করলে শিশুটি নিজেই বেলচা নিয়ে ময়লা তুলে ডাস্টবিনে ফেলে। রাস্তাটা ছিল ঝকঝকে তকতকে।

মাহাদী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ভাবছিল, ওদের রাস্তা কত পরিষ্কার; আর বাংলাদেশের পথঘাট কী নোংরা! অথচ একটু আগেই সে কলা খেয়ে বাসের জানালা দিয়ে রাস্তার ওপর ছুঁড়ে ফেলেছিল খোসাটা।

মাহাদী জানে জাপানিরা খুব নিয়মানুবর্তী এবং আত্মসচেতন জাতি। তার মনে পড়ল বিশ্বকাপে জাপান ফুটবল খেলায় হেরে যাওয়ার পরও জাপানি দর্শকদের স্টেডিয়াম পরিষ্কার করে আসার কথা। নিউজটা দেখে তার আক্ষেপ হচ্ছিল, ওরা কত সভ্য জাতি! আর আমরা…! অথচ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবায় যে পরিচ্ছন্নতাকাজ প্রায়ই হয় তাতে অংশ নেয়ার ইচ্ছা কখনো জাগে নি তার মনে।

মাহাদী অসৎ সরকারি চাকুরিজীবীদের মুণ্ডুপাত করেন নির্দ্বিধায়; অথচ ভুল করে রিসিভ করা ১০০০ টাকার জাল নোট আরেকজনকে গছিয়ে দেয় অবলীলায়।

আসলে বিদ্যমান অসঙ্গিতগুলোর জন্যে দায়ী এমন অজস্র ‘মাহাদী’!

অনেকেই অন্যের দোষ ধরতে পছন্দ করেন; ভাবেন ‘এই’ সমস্যা ‘এর’ কারণেই হলো! অথচ নিজের ভুলটা দেখেন না বা দেখেও উপেক্ষা করেন।

একই অবস্থা দেশ নিয়ে ভাবনাতেও। দেশের নানাবিধ সমস্যাই শুধু চোখে পড়ে। কিন্তু সমস্যা নিরসনে নিজের করণীয়টুকু নিয়ে ভাবি না। ফলে উন্নতিও আসে না। 

উদাহরণস্বরূপ- মাহাদী টয়লেট শেষে ফ্লাশ করে বেরোলেই তো পরের ব্যবহারকারী পরিষ্কার কমোড পেত! কলার খোসা ডাস্টবিনে ফেললে অন্তত একটা খোসা রাস্তায় কম জমত। স্বেচ্ছা পরিচ্ছন্নতা সেবায় অংশ নিলে আরেকটু পরিচ্ছন্ন হতো সড়ক।

কিউ ভঙ্গ করে টিকেট কাটার অনিয়মের শুরুটা হয়ত তাকে দিয়েই হয়েছিল!

নিজের ভুলে হস্তগত জাল নোট আরেকজনকে না দিলে আরেকটা অসৎ কাজ অন্তত হতো না।

আসলে এক মাহাদী নয়, এমন অজস্র ‘মাহাদী’ই দায়ী এই অসঙ্গগতিগুলোর জন্যে। যেখানে প্রত্যেকেই ভাবছে, আমি একা বদলালেই কি হবে! বা আমি একা কয়জনকে শোধরাবো?

আসলে অন্যকে শোধরানো আপনার কাজ নয়, সেটা হয়ত পারবেনও না। তবে পারবেন নিজেকে শোধরাতে। প্রত্যেকেই যখন নিজেকে শোধরানোর দায়িত্বটুকু সহীভাবে পালন করবে তখনই আসবে কাঙ্ক্ষিত বদল।

আবার এক আপনার দেখিয়ে দেয়া পথে হাঁটতে পারে অনেকে

হ্যাঁ, ভালো কাজও ‘সংক্রামক’ হতে পারে! এর অসংখ্য নজির আপনিও হয়ত দেখেছেন।

করোনাকালে যখন বহু মানুষ উপার্জনহীন হয়ে পড়েছিল, সুপারশপগুলোতে ‘প্যানিক বায়িং’ হচ্ছিল হরদম, তখনকার সময়ের একটি ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সুপারশপে ক্রেতারা কেনাকাটা শেষে লাইনে দাঁড়িয়ে বিল পরিশোধ করছিল। এক কাস্টমার তার বিলের সাথে অতিরিক্ত ৫ ডলার তার পরের ক্রেতার জন্যে নীরবে রেখে গেলেন। পরের ক্রেতার আর্থিক সামর্থ্যাভাব না থাকায় তিনি সেটা তো নিলেই না, উল্টো আরো ৫ ডলার রেখে গেলেন তার পরের ক্রেতার জন্যে। একই কাজ করলেন তার পরের ক্রেতাও।

এভাবে অল্প সময়ে সুপারশপ প্রতিনিধির হাতে জমল বড় অংকের অর্থ। শুরুটা করেছিল কিন্তু একজন!

আপনার তরফে ছোট্ট একটু বদল পরিবর্তন সূচিত করতে পারে সামগ্রিক সচেতনতায়

১৯৫২ সালে জাপানের কোজিমা দ্বীপের ম্যাকাকে শ্রেণির বানরের ওপর বিজ্ঞানীরা একটি গবেষণা চালান। এই বানরগুলোকে খেতে দেয়া হতো মিষ্টি আলু। সৈকতের ওপর পড়ে থাকায় আলুগুলোতে লেগে থাকত বালি। এই বালিমিশ্রিত আলু খেতে ভালো না লাগলেও উপায় কী? বানরগুলো এভাবেই আলু খাচ্ছিল।

একদিন দেড় বছর বয়সী একটি বানর দেখল সাগরের পানিতে আলু ধুয়ে নিলেই সেগুলোতে বালি থাকে না, মজা করে আলু খাওয়া যায়।

টেকনিকটি সে তার বন্ধুদের শেখালো। ছোটদের কাছ থেকে শিখল বড় বানরগুলোও।

এভাবে আলু ধুয়ে খাওয়ার টেকনিক জানা বানরের সংখ্যা বাড়ছিল, তবে তা ধীরে ধীরে। কিন্তু একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বানর যখন টেকনিকটি শিখল তখন ব্যাখ্যাতীত উপায়ে ঘটল এই শিক্ষার অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ; অল্প সময়ের মধ্যে দেখা গেল কোজিমা দ্বীপের সকল বানর আলু ধুয়ে খাচ্ছে!

এরচেয়ে বড় বিস্ময় হলো কিছু দিনের মধ্যেই আলু ধোয়ার অভ্যাস ছড়িয়ে পড়ল আশেপাশের দ্বীপগুলোর বানরের মধ্যেও, যাদের সাথে কোজিমা দ্বীপের কোনো যোগাযোগ নেই!

বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘The Hundredth Monkey Phenomenon’ তত্ত্ব দিয়ে 

সংক্ষেপে বললে, যখন কোনো চেতনা একটি তাৎপর্য সংখ্যক মানুষ গ্রহণ করে তখন ঘটে চেতনাগত বিস্ফোরণ। চেতনাটি তখন পরিণত হয় Collective Consciousness বা সামগ্রিক চেতনায়। ধরাছোঁয়া ছাড়াই তা ছড়িয়ে পড়ে জন থেকে জনে। হাজার হাজার, লাখ লাখ এমনকি কোটি কোটি মানুষ গ্রহণ করে সেই চেতনা। শুরুটা হয় কিন্তু একজনের হাত ধরেই!

‘আরব বসন্ত’-এর কথা-ই ধরা যাক

তিউনিসিয়ার সিদি বৌজিদ শহরে মোহাম্মদ বোয়াজিজি নামে এক যুবক রাষ্ট্রীয় অনিয়ম আর জুলুমের প্রতিবাদ করেন ২০১০ সালের ডিসেম্বরে গায়ে আগুন দিয়ে। একক প্রতিবাদ দ্রুতই পরিণত হয় লাখো কোটি মানুষের প্রতিবাদে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশ এবং তারপর পুরো আরব বিশ্বে। 

পরবর্তী কয়েক বছরে দশকের পর দশক ধরে চলা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে তিউনিসিয়া, মিশর, ইয়েমেন, সিরিয়াসহ ৯টি দেশে। এতবড় ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাতও কিন্তু মাত্র একজনের হাত ধরে!

তাই আসুন ‘আমি’ বদলাই 

নিজেকে বদলাতে অনেক বড় বড় কাজ কিন্তু করার প্রয়োজন নেই! মাত্র একটি বিষয় যদি মাথায় রাখেন তাহলেই আপনি বদলাবেন আর আপনার হাত ধরে বদলাবে দেশ। আর তা হলো নিজের কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করা।

আপনি কি শিক্ষার্থী? তাহলে জ্ঞানার্জনে আন্তরিক হোন, পড়ালেখা করুন ক্লাসে ১ম হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে।

যদি শিক্ষক হন তো নিজের জ্ঞানকে আরো বিকশিত করুন। আর তা সঞ্চারিত করুন শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

ডাক্তার হলে রোগীর সেবাকেই ব্রত হিসেবে গ্রহণ করুন।

আর যদি সরকারি চাকুরিজীবী হন তো দুর্নীতি বর্জন করে মানুষকে দিন সর্বোত্তম সেবা। 

ভাবছেন আমি তো গৃহিণী, আমি কীভাবে দেশ বদলে অবদান রাখব? পরিবার ভালো হলে ভালো হয় সমাজ তথা দেশ। তাই ঘরটাকে সুন্দরভাবে সামলানো মানেই দেশ গোছানো!

আর যে পেশায় যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, সচেতন হোন নিজের দেহমনের যত্নায়নে। নিজের যত্ন নেয়াও কিন্তু দেশপ্রেমের পরিচায়ক! কারণ নিজে সুস্থ না থাকলে আরেকজনকে সেবা দেবেন কীভাবে?

এভাবে আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজের যত্ন নেই, নিজের কাজ করি সবচেয়ে ভালোভাবে, মেধাকে পরিণত করি সেবায় তাহলেই বদলে যাবে দেশ। পরিণত হবে স্বর্গভূমি বাংলাদেশে।

ইনশাআল্লাহ্‌ সব সম্ভব!