টয়লেটে হাই কমোড লাগিয়ে কি আমরা জাতে উঠলাম, নাকি জাত হারালাম?

published : ২৯ নভেম্বর ২০২১

টয়লেটে হাই কমোড এখন যেন বিলাসিতার প্রতীক। গ্রাম হোক বা শহর, পাকা বাড়ি হবে, কিন্তু হাই কমোড থাকবে না- এটা আজকাল ভাবাই যায় না। জাতে ওঠার প্রয়াসে মানুষ এখন বাড়ি পাকা করার সাথে সাথে টয়লেটে সেট করছেন হাই কমোড। প্যান বা লো-কমোড নিয়ে নাক সিঁটকানোর মতো লোকের অভাব নেই।

কিন্তু হাই কমোড লাগিয়ে কি আমরা জাতে উঠলাম, নাকি জাত হারালাম?

পেছন ফিরে দেখা – যেভাবে চল হলো হাই কমোডের

হাই কমোড কিন্তু বেশিদিন আগের আবিষ্কার নয়। ষোড়শ শতকে ব্রিটেনের টিউডর শাসক পরিবার প্রথম হাই কমোড গ্রহণ করে। তবে সাধারণ মানুষ হাই কমোড ব্যবহার শুরু করে আরো পরে।

১৭৭৫ সালে আবিষ্কৃত হয় এস-আকৃতির পাইপ, যা কমোডের জলাধারের (Cistern) নিচে সহজে বসে যায়। এতে টয়লেট ব্যবহারের পর ফ্লাশ করা হয় সহজ। এই আবিষ্কারে ঘটে বিপ্লব। মানুষ আস্তে আস্তে হাই কমোডের দিকে ঝুঁকতে থাকে।

বিশেষতঃ ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি কলেরা প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষিতে লন্ডন সুয়ারেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন করলে চেয়ারের মতো করে বসে মলত্যাগের পর সহজে ও পুরোপুরি ফ্লাশ করা যায় এমন টয়লেট জনমানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। শুরুটা স্রেফ প্রয়োজনের তাগিদে হলেও আরামদায়ক বিধায় মানুষ মলত্যাগে বেঁছে নিচ্ছে হাই কমোড।

আর আমাদের দেশে হাই কমোডের ব্যবহার শুরু হয় ৮০’র দশক থেকে।

তবে পাশ্চাত্য, মানে যাদের হাত ধরে হাই কমোড এলো তারা-ই এখন এটাকে বর্জন করতে শুরু করেছে!

কারণ সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা গত পঞ্চাশ বছর ধরে গবেষণা করে দেখছেন যে, হাই কমোডে নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে।

আমেরিকান কলেজ অব গেস্ট্রোএন্টারোলজির পরিসংখ্যান হচ্ছে, বয়স ৫০ হওয়ার আগেই আমেরিকার অর্ধেক মানুষ হেমোরয়েডে ভুগতে শুরু করেন। তাদের পায়ু পথের শিরা ফুলে থাকে, এবং মলত্যাগের সময় রক্ত পড়ে। আর এ-সবের মূল্যে আছে মলত্যাগে হাই কমোড ব্যবহারে অভ্যস্ততা।

এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ১৯৭৮ সালে ক্রিসমাসের আগে পায়ুপথে হেমোরয়েডের তীব্র ব্যথার কারণে সপ্তাহখানেক রাষ্ট্রকার্য পরিচালনা থেকে অব্যহতি পর্যন্ত নিতে বাধ্য হন। তার প্রক্টোলজিস্ট (পায়ুপথ রোগ বিশেষজ্ঞ) প্রেসিডেন্টের সেই অসুস্থতার জন্যে দায়ী করেন কমোড ব্যবহারের অভ্যস্ততাকে।

কিন্তু হাই কমোডে মলত্যাগের অভ্যাস কেন এতো ক্ষতিকর?

কোষ্ঠকাঠিন্য, হেমোরয়েডস (অর্শ্বরোগ বা পাইলস), অন্ত্রের ক্যানসার- আগে আমাদের দেশে এই রোগগুলো কম হতো। কেন জানেন? কারণ তখন আমরা অভ্যস্ত ছিলাম প্যানে বসে মলত্যাগে। 

কিন্তু এখন হাই কমোডে উঁচু হয়ে বসার অভ্যাস থেকে তৈরি হচ্ছে নানাবিধ স্বাস্থ্যসমস্যা- এমনটাই বলা হয়েছে স্বাস্থ্যবিষয়ক ইসরায়েলি ম্যাগাজিন ‘জার্নাল অব মেডিকেল সায়েন্স’-এ সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায়। আর এর প্রধান কারণ হাই কমোডে বসার সময় রেচন অঙ্গগুলোর অবস্থান ভঙ্গিমা।

আমরা যখন প্যানে বসি তখন মলদ্বার ও রেক্টামের মাঝের অ্যাঙ্গেলটি থাকে ১২৬ ডিগ্রি। কমোডে বসলে তা কমে হয় ১০০ ডিগ্রি। ফলে প্যানে বসলে যেভাবে টক্সিনসহ সমস্ত মল বেরিয়ে যায়, কমোডে তা হয় না।


হাই কমোডে বসলে রেক্টাম সংকুচিত হয় বলে মলত্যাগ বাধাগ্রস্ত হয়। বিপরীতে প্যানে স্কোয়াট পজিশনে রেক্টাম থাকে চাপমুক্ত, নির্ভার (ছবিসূত্র- www.researchgate.net)

তা-ছাড়া কমোডে বসলে শরীরের উপরাংশের সাথে হিপ ও উরুর মধ্যে অ্যাঙ্গেল থাকে ৯০ ডিগ্রি, যা অন্ত্রের মধ্যকার চলাচল পথটাকে একরকম বন্ধই করে দেয়। এই অবস্থায় মলত্যাগের সময় পাকস্থলির উপর অস্বাভাবিক চাপ পড়ে।

আবার কমোডে মলত্যাগের সময় অনেকে শরীরের উপরাংশ সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখেন, যাতে পাকস্থলিতে চাপ লেগে মলত্যাগ ত্বরান্বিত হয়। এতে কিন্তু হিতে বিপরীতই হয়! কারণ এর ফলে অন্ত্রপথ যাওবা খোলা ছিল তা-ও বন্ধ হয়ে যায়।

কমোড কেন ক্ষতিকর তা বুঝতে মলত্যাগের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি আগে জানতে হবে

খাবার খাওয়ার পর হজম ও বিপাকক্রিয়া শেষে খাদ্যবর্জ্য কোলনে এসে জমা হয়। শরীর অতিরিক্ত পানিটুকু শুষে নেয়। বাকিটা মল হয়ে মলদ্বারে পৌঁছায়।


দেখুন হাই কমোডে বসলে মলনালীতে কতটা চাপ পড়ে! (ছবিসূত্র- www.researchgate.net)

এই মল ধরে রাখে পিউবোরেকটালিস পেশি (Puborectalis Muscle) যা দেখতে ইউ আকৃতির। যখন আমরা স্কোয়াটিং পজিশনে বসি তখন পেশিটি শিথিল হয় এবং সমস্ত টক্সিনসহ মল শরীর থেকে অনায়াসে বেরিয়ে যায়।

কিন্তু যখন কমোডে বসে কেউ মলত্যাগ করে তখন সংশ্লিষ্ট জায়গাটি সরু হয়ে যায়। ওপরদিকে চাপ পড়ে। ফলে মল নির্গমনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।

সহজে টয়লেট ক্লিয়ার হতে চায় না- এই অনুযোগ যে অনেকে করেন তার অন্যতম কারণ এটা-ই!

দীর্ঘদিন হাই কমোড ব্যবহারে যে-সব রোগ হতে পারে

মলত্যাগের জন্যে কমোডে বসলে মলদ্বার পুরোপুরি প্রশস্ত হতে পারে না, পেটে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চাপ পড়ে, পায়ুপথে শিরা টান খায় ও ফুলে যায়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে যারা কমোড ব্যবহার করেন তাদের কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলসের মতো রোগের আশঙ্কা বেড়ে যায়।

বিশেষতঃ দিনকে দিন যে ক্রনিক পাইলসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তা এই হাই কমোডে অভ্যস্ততার কারণেই- বহু গবেষণাতে মিলেছে এর প্রমাণ।

এর কারণটাও ব্যাখ্যা করা যাক!


হাই কমোডে অনেকের এতটা সময় লাগে যে বই, সংবাদপত্র বা স্মার্টফোনে সময়টা ব্যয় করে! (ছবিসূত্র- www.buzzfeed.com)

প্যানের তুলনায় হাই কমোডে বসে মলত্যাগ করতে সময় লাগে প্রায় আড়াইগুণ। ইসরায়েলি চিকিৎসক-গবেষক ডা. ডাভ সিকিরভ একটি গবেষণায় দেখেছেন, কমোডে মলত্যাগ করতে রোগীদের যেখানে সময় লেগেছে ১৩০ সেকেন্ড, সেখানে ফ্লোর প্যানে লেগেছে মাত্র ৫১ সেকেন্ড!

কলোরেক্টাল সার্জনদের মতে, মলত্যাগে যখন সময় বেশি লাগে কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার ঝুঁকিও তখন বেড়ে যায়

আমেরিকায় প্রতি বছর ২৫ লক্ষ মানুষ ডাক্তারের কাছে যায় স্রেফ কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা নিয়ে। এদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় ৯২ হাজার জনকে।

আর কোষ্ঠকাঠিন্য দীর্ঘদিন চললে একসময় তা থেকে হয় পাইলস।

এ-ছাড়াও মলত্যাগ বাধাগ্রস্ত হলে পেলভিক ফ্লোর বা মুত্রাশয়, মলদ্বার ও মহিলাদের জরায়ু এলাকার কার্যক্রম ব্যহত হয়। ফলে ব্যথা, ফুলে যাওয়া, ইউরিন লিকেজ ইত্যাদি জটিলতা দেখা দেয়।

প্রস্রাব ক্লিয়ার হয় না বলে হাই কমোড ব্যবহারে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনও সৃষ্টি হতে পারে।

আর সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে আসে বলে কমোডের মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে জীবাণু সংক্রমণ ছড়াতে পারে। বিশেষ করে পাবলিক টয়লেটে উঁচু কমোডে না বসার পরামর্শই দেন বিশেষজ্ঞরা।

আরো আছে! অনেকে হাই কমোডে টয়লেট ক্লিয়ার করতে জোর করে চেষ্টা করেন। ফলে চাপ পড়ে মলদ্বারের ওপর। টয়লেট করার সময় এভাবে ক্রমাগত চাপ দিলে একটা বয়সে এসে মলদ্বার ঝুলে পড়ে। হার্নিয়ার মত রোগগুলো হয় মূলত এ-কারণেই।

এমনকি হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ক্যান্সারের কারণ হতে পারে দীর্ঘদিন হাই কমোড ব্যবহার!

পশ্চিমের দেশগুলোতে অধিকাংশ হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক হয় বাথরুমে। এগুলোর সাথে হাই কমোডে বসার সরাসরি যোগ রয়েছে বলে অভিমত দিয়েছেন ইসরায়েলের ড. বারকোসিকিরোভ। গবেষকরা ধারণা করছেন, চাপ দিয়ে মলত্যাগের জন্যেই এই সমস্যা হয়।

এ-ছাড়াও ক্যান্সার গবেষকদের মতে, কোলন বা মলাশয়ের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ দীর্ঘদিন ধরে কমোডের ব্যবহার। কারণ এটি ব্যবহারের সময় পেশিতে চাপ দিতে হয় বলে অন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। ক্যান্সার হওয়ার কারণ এটা-ই।

নিঃসন্দেহে সুস্থতা আমাদের সেরা সম্পদ। এখন আপনি-ই বলুন, হাই কমোড ব্যবহারের মাধ্যমে এই অমূল্য সম্পদকে বিকিয়ে দিয়ে আমরা কি জাতে উঠেছি, না জাত হারিয়েছি?

তাহলে এখন করণীয়?

অপারেশন ছাড়াই এই রোগগুলো থেকে নিরাময়ের যে উপায়গুলোর কথা এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন তার মধ্যে আছে আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া, ওজন কমানো ও মলত্যাগে সঠিক ভঙ্গি অনুসরণ। আর তা হলো প্যানে বসা।

কারণ প্যানে ডিপ স্কোয়াট পজিশনে মলত্যাগই অধিক স্বাস্থ্যসম্মত।

পাশ্চাত্যের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা তাদের প্রায় অর্ধশতকের গবেষণার ভিত্তিতে বলছেন, মলত্যাগে স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যসম্মত ভঙ্গি হলো এ-সময় দুই ঊরু পেটের সাথে লেগে থাকবে। গ্যাস্ট্রোএন্টেরলজির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পাঠ্যবই ‘বোকাস গ্যাস্ট্রোএন্টেরেলজি’তেও এটা-ই বলা হয়েছে।

কেন? কারণ দুই ঊরু পেটের সাথে লেগে থাকলে মলদ্বার পুরোপুরি প্রশস্ত হয়। মলত্যাগ হয় খুব সহজ।

প্যানে বসে মলত্যাগের সময় আমাদের রেচন অঙ্গগুলো যে ভঙ্গিতে থাকে তা রেচনক্রিয়াকে করে সহজতর ও দ্রুত। এতে প্রতিহত হয় মলাবদ্ধতা, যা কোলন ক্যান্সার, অ্যাপেন্ডিসাইটিস ও আইবিএস-এর অন্যতম প্রধান কারণ।

আর এই ভঙ্গিমায় হিপের প্রসারণ বেশি হয় বলে রেচন অঙ্গগুলোর উপর ধকলও পড়ে কম- এমনটাই দেখা গেছে কয়েকটি গবেষণায়।

আসলে মানবদেহের অ্যানাটমি থেকে বোঝা যায় যে, প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের দেহ সৃষ্টি ডিপ স্কোয়াট ভঙ্গিমায় রেচনক্রিয়ার জন্যে। আর তা সম্ভব কেবল প্যানেই!

তাই হাই কমোড বর্জন করুন, টয়লেটে স্বাগত জানান প্যানকে!

যদি টয়লেটে হাই কমোড লাগিয়ে থাকেন তাহলে আজই এটা সরিয়ে বাংলা প্যান বসান। কারণ অহেতুক ফুটানির চেয়ে আপনার স্বাস্থ্যরক্ষা অনেক বেশি জরুরী।

তবে সেটা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ একটি টেকনিক ব্যবহার করতে পারেন।


মলত্যাগের স্বাস্থ্যসম্মত ভঙ্গি হলো এমনভাবে বসা, যাতে শরীরের ঊর্ধ্বাংশ ও উরুর মধ্যে ৩৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল ফাঁকা থাকে (ছবিসূত্র- ইন্ডিয়া টাইমস)

টয়লেটে মাঝারি উচ্চতার একটি টুল রাখুন। কমোডে বসার সময় টুলের উপর এমনভাবে পা উঠিয়ে বসুন যাতে শরীরের ঊর্ধাংশ ও উরুর মধ্যে ৩৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল ফাঁকা থাকে। কারণ এই অ্যাঙ্গেলে রেকটামের সংকোচন প্রতিহত হয়। ফলে মল নির্গমণ হয় স্বচ্ছন্দ ও সহজতর।

আপনার এই সচেতন প্রয়াস আপনাকে বাঁচিয়ে দেবে পাকস্থলী, অন্ত্র, রেকটাম ও মলদ্বারের নানাবিধ রোগ থেকে।