নিরাপদ ব্যথানাশক শিথিলায়ন

নগর জীবনে কোনো বাসা পাওয়া যাবে না, যে বাসায় ব্যথানাশক ওষুধ বা ‘পেইনকিলার’ নেই। নানা নামে নানা মোড়কে সযত্নে রাখা হয় এই ব্যথানাশক ট্যাবলেট। কোনোটা মাথা ব্যথার জন্যে, কোনোটা ঘাড়ে ব্যথার জন্যে, কোনোটা কোমরে ব্যথার জন্যে, কোনোটা হাঁটুতে ব্যথার জন্যে। প্রয়োজনে একাধিক ট্যাবলেট পানির সাথে গলাধঃকরণ করে ফেলি। ব্যথা দূর না হলেও আমরা সাময়িক উপশম অনুভব করি। ব্যথানাশক ওষুধ যতই খাই না কেন ব্যথার পুনরাবৃত্তি বার বার ঘটে। আর বার বারই ব্যথার ওষুধ খেলে পাকস্থলীর ভেতরে আবরণী ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর নানা পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তাই ওষুধ ছাড়াও ব্যথা নিরাময় করা যায় এ খবর নিঃসন্দেহে একটা বড় খবর। আর ডাক্তারই যদি বলেন যে, সবচেয়ে শক্তিশালী বেদনানাশক হচ্ছে আপনার মন, তখন খবরটি নিঃসন্দেহে অনেক গুরুত্ববহ হয়ে দাঁড়ায়।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের বাঘা বাঘা ডাক্তারদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেল সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে, গভীর শিথিলায়ন ওষুধ ও সার্জারির মতই দ্রুত ক্রনিক ব্যথা থেকে মুক্তি দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত চিকিৎসা বিজ্ঞানের সনাতন ধারণা থেকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম। এই প্রথমবারের মত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রথিতযশা চিকিৎসাবিদরা সরকারিভাবে শিথিলায়নকে কোমরব্যথা, মাথাব্যথা, আর্থ্রাইটিস এবং অন্যান্য ক্রনিক ব্যথা নিরাময়ের কার্যকরী প্রক্রিয়া হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন। আর পেইন কিলার বা সার্জারির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকলেও শিথিলায়নের তেমন কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই। চুপচাপ বসে দম অবলোকন করতে গিয়ে আজ পর্যন্ত কারোরই পাকস্থলীর আবরণ ক্ষতিগ্রস্থ হয় নি। শিথিলায়নকে নিরাময় প্রক্রিয়া হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার খবর বেরিয়েছে ডাক্তারদের বিখ্যাত সাময়িকী ‘জার্নাল অফ দি আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশন’-এর জুলাই ২৪/৩১, ১৯৯৬ সংখ্যায়।

শিথিলায়নের মাধ্যমে ব্যথা উপশম করার জন্যে আপনার দরবেশ, সন্ন্যাসী বা ভিক্ষু হওয়ার প্রয়োজন নেই। এজন্যে নির্বাণ বা ফানাফিল্লাহর স্তরেও আপনাকে যেতে হবে না। এজন্যে চুপচাপ একটু নীরবে বসার মত জায়গা পেলেই যথেষ্ট। কারণ শিথিলায়নের পুরো প্রক্রিয়াটাই হচ্ছে মনের। শিথিলায়ন ভেতর থেকে কাজ করে। দৈনন্দিন চিন্তা থেকে নিজেকে কিছুক্ষণের জন্যে আলাদা করে ফেললেই আপনি শিথিল হতে শুরু করেন। মাইন্ড বডি ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট ও হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের বিহেভিওরাল মেডিসিনের পরিচালক ডা. হার্বার্ট বেনসন খুব চমৎকারভাবে বলেছেন, ভেতর থেকে শিথিল হতে শুরু করলেই আপনার শরীর ১৮০ ডিগ্রী মোড় নেয়, উত্তেজনা থেকে পুনর্নির্মাণের স্তরে ফিরে যায়। পেশী শিথিল হয়ে যায়, দম ধীর হয়, বিপাক ক্রিয়া ও রক্তচাপ কমে যায়। পক্ষান্তরে উত্তেজিত অবস্থায় পেশী শক্ত হয়ে যায়, রক্তচাপ বাড়ে, কম দ্রুত হয়, ব্যথা-বেদনা বেড়ে যায়।

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের এনেসথেসিওলজি ও ব্যথা গবেষণা বিভাগের প্রফেসর ডা. ডেনিস টার্ক খুব সুন্দরভাবে বলেছেন, গভীর শিথিলায়ন শর্ট সার্কিটে করে ব্যথা বিনাশের সাথে সাথে ব্যথার সাথে জড়িত আবেগকেও বিনাশ করে। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে কষ্টকর ব্যাপার হচ্ছে, রাত তিনটার সময় যখন আপনি প্রচন্ড মাথাব্যথা বা ব্যাকপেইন-এর কারণে জেগে ওঠেন তখন আপনার নিজেকে প্রচন্ড অসহায় মনে হয়। মনে হয় এখন আপনার কিছুই করার নেই। আপনি বিছানায় শুয়ে আহাজারি করেন। ভাবেন কিছুই করার নেই। সে সময় যদি আপনি শিথিলায়নের টেকনিক প্রয়োগ করতে পারেন, তাহলে পরিস্থিতির উপর একটা নিয়ন্ত্রণ আসতে থাকে। অসহায়ত্বের ভাব কমে যায়। সেই সাথে কমে যায় ব্যথার কষ্ট।

ব্যথা-বেদনা নাশে শিথিলায়নের প্রভাব সম্পর্কে আমাদের দেশে ডাক্তার ও রোগীদের মধ্যে তেমন কোনো সচেতনতা না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রে ডাক্তার ও রোগীদের মধ্যে শিথিলায়ন বা মেডিটেশন সচেতনতা এখন অনেক প্রবল। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত চিকিৎসা মাসিক প্রিভেনশন-এর জুন, ১৯৯৭ সংখ্যায় সারা দেশে পরিচালিত জরিপের ফলাফল বলা হয়েছে, ৩০% আমেরিকান পেইনকিলার সেবন করে, ৩৫% ব্যথা অবহেলা করে, ২৭% শিথিলায়ন করে ব্যথা কমায়। ৭৫% আমেরিকান মনে করে যে, ওষুধ ছাড়াই ব্যথা উপশম সম্ভব। ২৩% আমেরিকান জানান যে, তাদের ডাক্তাররা তাদেরকে ওষুধ বাদ দিয়ে শিথিলায়নের মাধ্যমে ব্যথা উপশমের পরামর্শ দিয়েছেন।

এই জরিপে দেখা যায় যে, ক্রম অনুসারে মাথাব্যথা, পেশীর ব্যথা, ব্যাকপেইন, মহিলাদের মাসিক সময়ের ব্যথা, যন্ত্রণা, আর্থ্রাইটিস, পায়ে ব্যথা এসব সাধারণ ব্যথা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এ ধরনের প্রতিটি ব্যথার ক্ষেত্রেই পেইন কিলারের চেয়ে শিথিলায়নের কার্যকারিতা কোনো অংশে কম নয়। আর শিথিলায়ন বা মেডিটেশনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই। (ব্যথা নাশে শিথিলায়ন করার জন্যে আপনি প্রজাপতি প্রকাশনের ‘কোয়ান্টাম মেথড’ বই সংগ্রহ করে শিথিলায়ন আয়ত্ত করতে পারেন।)