অসুস্থতার কারণ কী? মেডিটেশন করে কি সুস্থ থাকা যায়?

এখনকার মতো এত হাসপাতাল, এত চিকিৎসক, এত সুযোগ-সুবিধা আগে কখনো ছিল না। এত এত হাসপাতাল, তবু রোগী ধরে না। এত মেডিকেল সুযোগ-সুবিধা, তবু মানুষ পরিপূর্ণ সুস্থ হতে পারছে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এত উন্নতির পরও আমরা অসুস্থ হচ্ছি। কেন? 

বুঝতে হলে জানতে হবে সুস্থতা বলতে আসলে কী বোঝায়

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুস্বাস্থ্যের এক অভূতপূর্ব সংজ্ঞা দিয়েছে-

Health is a state of complete physical, mental and social well-being and not merely the absence of disease or infirmity.

অর্থাৎ, কেবল রোগ বা অক্ষমতার অনুপস্থিতিই সুস্বাস্থ্য নয়। বরং একজন মানুষকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তখনই বলা যাবে যখন তিনি শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে সুস্থ থাকবেন।

আসলে আমরা সুস্থ থাকতে গিয়ে শুধু দৈহিক সুস্থতার ওপর জোর দেই, সুস্থতার বাকি অনুষঙ্গগুলোর যত্ন নেই না। পরিপূর্ণ সুস্থ হতে পারছি না এ-কারণেই।

এ-ব্যাপারে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন কী বলছে?

সংস্থাটির অফিসিয়াল জার্নাল ‘সার্কুলেশন’-এ প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে বলা হয়েছে, চিকিৎসক হিসেবে আমরা ভালো রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে। পুরো মানুষটির চিকিৎসা করতে আমরা ততটা ভালো নই! চিকিৎসকদের মনোযোগ থাকে নির্দিষ্ট শারীরিক অবস্থা তথা রোগের ওপর। রোগীর পুরো অস্তিত্বকে বিবেচনা করা হয় না। 

আর্টিকেলে আরো বলা হয়েছে- হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে নেতিবাচক আবেগ যেমন- স্ট্রেস, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, টেনশন, ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা।

আধুনিক মানুষের বড় সমস্যা ক্রনিক স্ট্রেস। রাগ, ক্রোধ, হতাশা তার ভেতরে বাসা বেঁধেছে। তার ভেতরে শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা নেই। কোনোকিছুতেই তৃপ্তি আসে না। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন বলছে, কোনো ব্যক্তির ভেতরে যদি এগুলো থাকে তাহলে তার হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক হওয়া সময়ের ব্যাপার!

এখন আপনিই বলুন, রোগীর সামাজিক, মানসিক, আত্মিক এই দিকগুলো বাদ দিয়ে শুধু ওষুধ দিয়ে কি পরিপূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব?

সুস্থ রাখতে হবে মন ও আত্মাকে 

মানুষের শুধু দেহটাই মানুষ নয়। মানুষ হলো দেহ, মন এবং আত্মার সমন্বয়। 

দেহ দেখা যায়, দেহের অসুস্থতা পরিমাপও করা যায়। দেহকে সুস্থ করে তুলতে করণীয় বুঝতেও সমস্যা হয় না কারো। কিন্তু মন এবং আত্মা দেখা, ধরাছোঁয়া যায় না। ফলে এদের গুরুত্ব আমরা বুঝি না যতক্ষণ না মানসিক বা আত্মিকভাবে রোগী হই।

দিনের পর দিন মন খারাপ থাকলে একটা সময় মানুষ আক্রান্ত হয় বিষণ্ণতায়। শরীরের সুস্থতা তখন হয় বিপন্ন।

আর সমস্ত প্রাপ্তিই অর্থহীন হয়ে যায় যখন আত্মিক শূন্যতা কারো মধ্যে থাকে। এজন্যেই সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহন করার পরও অনেককেই আত্মহত্যা করতে দেখা যায়।

তাই মন এবং আত্মাকে অসুস্থ রেখে দেহের সুস্থতা বজায় রাখা অসম্ভব।

পরিপূর্ণ সুস্থতায় করণীয়

আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন বলছে, মন এবং আত্মাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে মেডিটেশন অনুশীলন করতে হবে। কারণ মেডিটেশন নেতিবাচক আবেগ দূর করে।

ধরুন, আপনার রাগ বেশি, আর রাগের কারণে আপনি হৃদরোগী। মেডিকেল সায়েন্স এটা বলছে। এখন ডায়াগনসিস তো হলো, কিন্তু নিরাময়? কোনো ডাক্তার, কোনো হাসপাতাল, কোনো ওষুধ কি আপনার রাগ কমাতে পারবে? পারবে না। 

আবার ব্যবসায়ে কোটি টাকা ক্ষতি হওয়ার দুঃখে আপনি হার্ট অ্যাটাক করেছেন। সুস্থ থাকতে হলে আপনার হৃদয়ের উপশম ঘটাতে হবে। কিন্তু ডাক্তার, হাসপাতাল কিংবা ওষুধ আপনার মনের ব্যথা কমাতে পারবে না। 

সমস্যাগুলো মনের, তাই মন থেকেই এগুলো দূর করতে হবে। 

এ-জন্যেই প্রয়োজন মেডিটেশন

আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন বলছে, মেডিটেশনের মাধ্যমে নেতিবাচক আবেগগুলো দূর করা সম্ভব। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ড. স্টিভেন লরিস।

বেলজিয়ামের লিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজিস্ট প্রফেসর ছিলেন তিনি। অত্যন্ত সফল মানুষ। কোনোকিছুরই কমতি নেই। সুখী এই মানুষটির জীবনে অকস্মাৎ নেমে এলো বিপদ! পরকীয়ার জেরে স্ত্রী আরেকজনের সাথে চলে গেলে তিন সন্তানকে নিয়ে অথৈ সমুদ্রে পড়লেন ডা. লরিস। আক্রান্ত হলেন বিষণ্ণতায়। যত চিকিৎসা আছে, সব নিলেন। কিন্তু সমস্যার সমাধান হলো না। উদ্বেগ কষ্ট হতাশা দূর হচ্ছিল না কিছুতেই। 

বন্ধুর পরামর্শে তিনি মেডিটেশন শুরু করলেন। ঘটল মিরাকেল! 

আধুনিক মেডিকেল সায়েন্স যেখানে হার মানলো, সেখানে মেডিটেশন করে তিনি ধীরে ধীরে বিষণ্ণতা থেকে মুক্ত হলেন। এ থেকে তিনি এতটাই অনুপ্রাণিত হলেন যে মেডিটেশন নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করলেন। গবেষণার আলোকে লিখলেন No Nonsense Meditation Book নামে একটি ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট সেলার বই। 

বইয়ে স্টিভেন লরিস মেডিটেশনকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন

ডা. লরিস মেডিটেশনের কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করেছেন নিউরোসায়েন্সের আলোকে। তিনি মেডিটেশনকে আখ্যায়িত করেছেন মস্তিষ্কের ব্যায়াম। আপনি মেডিটেশনে যখন চোখ বন্ধ করে কোনোকিছু কল্পনা করছেন তখন আপনি কিছুই করছেন না, তা নয়। বরং জেগে থাকা অবস্থায় ব্রেনকে যতটা কাজে লাগাচ্ছিলেন, মেডিটেটিভ লেভেলে কাজ করাচ্ছিলেন তার চেয়ে বেশি।

কেউ যখন নিয়মিত দৌঁড়ান, তার কাফ এবং থাইয়ের মাসল শক্তিশালী হয়। যখন নিয়মিত সাঁতার কাটেন, তার কাঁধের পেশী শক্তিশালী হয়। 

তেমনি কেউ যখন নিয়মিত মেডিটেশন করেন তখন তার মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশ প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স, এমিগডালা, হিপোক্যাম্পাস শক্তিশালী হয়। গ্রে ম্যাটারের পরিমাণ এবং ঘনত্ব বাড়ে। ফলে এগুলো দারুণভাবে কাজ করতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে আমরা থাকি সুস্থ ও প্রাণবন্ত।

ড. লরিসের ক্ষেত্রে কী হয়েছিল? 

তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু যখন মেডিটেশন করতে শুরু করলেন তখন ক্রমান্বয়ে সুস্থ হতে থাকলেন। 

নেতিবাচক আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণ কমতে শুরু হলো। নিঃসরণ বাড়তে শুরু হলো সুখের অনুভূতি সৃষ্টিকারী কেমিকেল ডোপামিন, সেরেটনিন, অক্সিটসিন, এন্ডরফিন। ফলে ভেতরে একটা আনন্দ অনুরণন তৈরি হয়ে গেল। কিছুদিন পর তিনি অনুভব করলেন পারিপার্শ্বিক দুঃখ-কষ্ট সেভাবে তাকে স্পর্শ করছে না। এটাই মেডিটেশনের গুণ!

তাই এই সফল নিউরোসায়েন্টিস্টের মতো আপনিও নিয়মিত মেডিটেশন করুন, সুস্থ সবল প্রাণবন্ত থাকুন।