ফিটনেস নিয়ে এই ৫টি ভুল ধারণা কি আপনারও আছে?

ফিট থাকতে কে না চায়! কিন্তু পরিপূর্ণ ফিটনেস বলতে আসলে কী বোঝায় সে ব্যাপারে ধারণা নেই বেশিরভাগেরই। সেই সাথে আছে কিছু ভুল ধারণাও। ফলে ফিটনেসের শুরু এক/দুই দিকে মনোযোগ দেয়ায় অন্য দিকগুলো রয়ে যায় অপুষ্ট।

আসুন, জেনে নেই ফিটনেস সংক্রান্ত ৫টি ভুল ধারণা-

১. 'ফিটনেস কেবল দেহের বিষয়'

হালের তরুণ-তরুণীদের অনেকের মধ্যে আছে ফিটনেস ক্রেজ। ঘাম ঝরানো জিম এক্সারসাইজ থেকে শুরু করে কঠোর ডায়েট কন্ট্রোল- বাদ রাখছেন না কিছুই। অর্থাৎ, ফিট থাকার প্রয়াসগুলোর সবই আবর্তিত হচ্ছে শরীরকে কেন্দ্রে রেখে।

আমাদের ফিট থাকার চেষ্টাগুলো মূলত শরীর কেন্দ্রিক (ছবিসূত্র- pulseservicesbd.com)

কিন্তু সুস্থতা বা ফিটনেস কেবল দেহের বিষয় নয়। সুস্থতার ধারণা আসলে আরো ব্যাপক।

WHO বলছে, “Heath is a state of complete physical mental social and spiritual wellbeing”. অর্থাৎ, দৈহিক মানসিক সামাজিক এবং আত্মিকভাবে ভালো থাকার নাম- ‘সুস্থতা’।

আপনিই ভাবুন, শুধু শরীর স্লিম থাকলেই কি আপনি ভালো থাকতে পারবেন? পারবেন না। কারণ শরীরের সাথে মনের সম্পর্ক গভীর। তাই মনটাও ফিট থাকতে হবে।

আর, আপনি তো সমাজে একা নন! আপনার আছে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-প্রতিবেশী। সমাজের সবাইকে নিয়ে ভালো থাকলেই সবার ভালো থাকা নিশ্চিত হয়।

তবে সব পাওয়ার পরও আপনি অসুখী রয়ে যাবেন যদি আত্মিকভাবে তৃপ্ত না হন। আত্মিক শূন্যতা নিষ্ফল করে দেবে বাকি সকল প্রাপ্তিকে।

অতএব, শারীরিক মানসিক সামাজিক আত্মিক- সবগুলো ক্ষেত্রেই যদি আপনি ফিট হন তাহলেই আপনি হবেন পরিপূর্ণ ফিট!

২. 'নীরোগ মানেই ফিট!'

অনেকের ধারণা, “শরীরটা সুস্থ আছে, খেয়েপড়ে বেঁচে আছি- ব্যস, আমি ফিট!” কিন্তু শরীর সুস্থ তথা নীরোগ থাকা শারীরিক ফিটনেসের একটিমাত্র অনুষঙ্গ। আরো কিছু মানদণ্ডের আলোকে নির্ধারিত হবে আপনার শারীরিক ফিটনেস

আপনি কি ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লান্তি ও বিরক্তিহীনভাবে কাজ করতে পারেন? প্রয়োজনে দু’য়েক রাত জাগলে কি পরের দিনগুলোতে ঘন ঘন হাই তোলা, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করার মতো উপসর্গগুলো থেকে মুক্ত থাকেন? এক/দুই বেলা না খেলেও কি আপনার চেহারা সেটার জানান দেয় না?

যদি প্রশ্নগুলোর উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয় তাহলে আপনার শরীর ফিট! অন্যথায় আপনাকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে নজর দিতে হবে।

৩. 'ফিট হতে হলে বিশেষ আকার/কাঠামোর অধিকারী হতে হবে'

সুপার স্লিম বডি বা তথাকথিত 'জিরো ফিগার' কিংবা জিম করা পেশিবহুল শরীরধারী হলেই আপনি ফিট নন! অন্য কথায়, ফিট হতে হলে বিশেষ দেহকাঠামোর অধিকারী হওয়ার প্রয়োজন নেই।

পেশীবহুল শরীরই ফিট শরীর- প্রচলিত ভুল ধারণা

পরিচিতমণ্ডলে আপনি এমন অনেককেই পাবেন হ্যাংলা-পাতলা হওয়ায় যাদের বন্ধুমহলে বিশেষ কিছু উপনাম জুটলেও তাদের শারীরিক সক্ষমতা বা স্ট্যামিনা ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। রানিং ট্র্যাকে নামিয়ে দেখুন, স্বাস্থ্যবানদের অনেকেই তাদের পেছনে পড়ে যাবে!

করোনাকালে আমরা আমাদের এমন বহু স্বেচ্ছা দাফনকর্মীকে দেখেছি, যারা যথেষ্ট মোটাতাজা না হলেও গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যে পিপিই-তে পুরো শরীর মুড়ে দাফনের মতো শ্রমবহুল কাজটা করেছেন অবলীলায়।

৪. 'বয়সের সাথে সাথে ফিটনেস কমে যায়!'

একদম বোগাস কথা! ফিটনেস বয়সের কারণে কমে না; কমে ভুল কাজ আর অবৈজ্ঞানিক খাদ্যাভ্যাসের কারণে।

১২৬ বছর বয়সী জীবন্ত সাধক বাবা শিবানন্দ গোস্বামী। এটি ২০১৪ সালের ছবি যখন তার বয়স ছিল ১১৮ বছর! চেহারা দেখে কে বলবে এনার বয়স!

সাম্প্রতিক বিশ্বের বয়স্কতম মানুষ হলেন বাবা শিবানন্দ গোস্বামী। বয়স কত জানেন? ১২৬ বছর!

না, সারাদিন বিছানায় শুয়েবসে থাকা রোগগ্রস্ত, চামড়া ঝুলে পড়া থুত্থুড়ে বুড়ো নন তিনি! তার শারীরিক অবস্থা এত চমৎকার যে, তাকে দেখে বড়জোর বছর পঞ্চাশের মনে হবে আপনার!

কয়েক বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে তার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা গেছে, তার ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিক, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে, হার্ট কিডনি লিভার সম্পূর্ণ সুস্থ। চশমা পড়েন না; লাঠি ছাড়াই দিব্যি হেঁটেচলে বেড়ান। স্মৃতি এবং চিন্তাশক্তি পুরোপুরি কর্মক্ষম।

সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ ফিট শরীরের মানুষ বাবা শিবানন্দ। যে-কোনো বয়সেই যে শরীরের ফিটনেস ধরে রাখা যায় তার এক জ্বলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত তিনি।

৫. 'ফিটনেস বাড়াতে বা ধরে রাখতে প্রচুর খেতে হবে'

ফিটনেসের সাথে খাবারের যোগ আছে- এটা ঠিক। কিন্তু ফিট হতে আপনাকে প্রচুর খেতে হবে তা নয়। বরং প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খেলে ফিটনেস হারাবেন আপনি।

মেক্সিকোর উত্তর সনোরায় বসবাসরত তারাহুমারা উপজাতির কথাই ধরা যাক না। সমুদ্র থেকে উঁচু পার্বত্য এলাকায় তাদের বাস। অনুর্বর জমিতে কিছুই চাষ করা যায় না ভুট্টা ছাড়া। এক বছরে তাদের খাবারের পরিমাণ হচ্ছে ১০০ কিলো কর্ন। সবজির পরিমাণ খুবই কম। গোশত খাওয়া হয় বছরে ২/১ দিন ‘শিন্নির’ মতো।

মেক্সিকোর তারাহুমারা উপজাতির মানুষেরা খুব কম খাবার গ্রহণ করেও স্বাস্থ্যোজ্বল (ছবিসূত্র ultra-x.co)

তারপরেও তারা ২৫ থেকে ৫০ মাইল দৌড়াতে পারে। প্রতি সপ্তাহে পুরো গোত্রকেই একবার ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিতে হয়। দৌড়ালে হার্ট রেট বাড়ে। কিন্তু এই ম্যারাথনে বিজয়ীর হার্ট রেট দৌড়ের ২ মিনিট পরে পরীক্ষা করে দেখা গেল, হার্ট রেট কমে গেছে। তাদের সাধারণভাবে কোনো অসুখ-বিসুখ ছিল না। তাদের মন-দেহ প্রক্রিয়া চমৎকারভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল এই তথাকথিত ‘সাব-স্ট্যান্ডার্ড ডায়েটে’র সাথে।

এরপর পাশ্চাত্যের সভ্য মানুষদের পাল্লায় পড়ার সাথে সাথে তাদেরকে দেয়া হলো ভিটামিন, মিনারেল ও প্রোটিন সমৃদ্ধ স্ট্যান্ডার্ড খাবার। এক বছরের মধ্যেই তাদের মধ্যে মহামারি আকারে হাইপারটেনশন, হৃদরোগ, চর্মরোগ, দন্তরোগ, এলার্জি ইত্যাদি দেখা দেয়। অথচ এ ব্যাধিগুলোর কোনোটিরই অস্তিত্ব তাদের মধ্যে ছিল না।

আসলে খাবার বা ডায়েট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ খাবার সম্পর্কিত অবচেতন মনের তথ্যের পুনর্বিন্যাস। হয়তো দেখা যায় যে একজন প্রচুর খেয়েও শরীরে মেদ জমাতে পারে না, অন্যদিকে আরেকজন স্রেফ পানি খেয়েও মেদ বাড়িয়ে ফেলে তার দেহে।

অবচেতনে তথ্যের পুনর্বিন্যাস দ্বারা একজন মানুষ খুব কম খেয়েও সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারেন। যেমন আমাদের দেশের সত্যিকারের দরবেশ-ঋষিরা করেছেন। আমাদের দেহ-মন প্রক্রিয়া আসলে পরিবেশ ও প্রয়োজনের সাথে চমৎকার খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

খাবারের ব্যাপারে এই সচেতনতা, পাশাপাশি প্রতিদিন দুই বেলা মেডিটেশন আর আধ ঘন্টা ইয়োগা করলে শারীরিক ফিটনেসের পাশাপাশি আপনি অর্জন করতে পারবেন ফিটনেসের অন্য অনুষঙ্গগুলোও।