মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? প্রতিরোধে করণীয় কী?

  • আত্মহত্যা- ১৫-১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর ৪র্থ বৃহত্তম কারণ, ১৪-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ২য়;
  • বাংলাদেশে আত্মহত্যা : লাখে ৮ জন, দৈনিক গড়ে ৩০- প্রতিবেদন WHO-র;
  • চলমান প্যান্ডেমিকের ১ বছরে দেশে করোনার চেয়ে আত্মহত্যার দরুন মৃত্যু ৭০% বেশি!
  • আত্মহত্যাকারীদের ৩৫ শতাংশই টিন-এজার বা অপ্রাপ্তবয়স্ক!
  • আত্মহত্যাপ্রবণদের শতকরা ৯০ ভাগই কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে

একটি বাস্তব ঘটনা...

১৩ বছরের একটি মেয়ে। পড়তো ঢাকার প্রথম সারির একটি স্কুলে ৮ম শ্রেণীতে। লেখাপড়া খেলাধুলা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই তার ছিল স্বচ্ছন্দ পদচারণা। পরিবারের আদরের, শিক্ষকদের স্নেহের, সহপাঠীদের ভালবাসার মধ্যমণি হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত কিশোরীটিকে দেখে কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি তার মনোজগতে কী তোলপাড় চলছে। যখন বুঝল ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে! তার আকস্মিক আত্মহত্যা সবাইকে স্তব্ধ করে দেয়।

মেয়েটির আধুনিক শিক্ষিত আর মুক্তমনা বাবা-মা হতবিহ্বল-বাকরুদ্ধ। সন্তান লালনে তাদের ভুলটা কোথায়?

এমন অজস্র বাবা-মা সন্তান হারানোর শোক বুকে নিয়ে কারণ খুঁজে বেড়ায়, হাতড়ে ফেরে নিজেদের দায়। কারণ খোঁজেন সমাজবিদ, মনোবিজ্ঞানী আর মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও।

করোনা-ডেথকে ছাড়িয়ে গেছে আত্মহত্যা!

দুনিয়াব্যাপী মৃত্যুর বড় একটি কারণ হলো আত্মহত্যা, যার ছাপ পড়েছে এদেশেও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে এখন লাখে ৮ জন আত্মহত্যা করছে। সে হিসেবে দিনে গড়ে ৩০ জন মানুষ বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২০ সালে ১১,২৫৯ জন আত্মহত্যা করে। আগের বছর যা ছিল ৯,৩১০ জন। এক বছরে আত্মহত্যা বেড়েছে ১৭.৩১ শতাংশ। অন্যদিকে, গবেষকদের মতে প্রতিটি আত্মহত্যার বিপরীতে আত্মহত্যাচেষ্টা থাকে ২০-৩০ গুন!

করোনার এই সময়ে দেশে আত্মহত্যার হার বাড়তে দেখা যাচ্ছে। মার্চ, ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০২১- এই এক বছরে আত্মহত্যা করেছে ১৪,৪৩৬ জন, যার মধ্যে আছে করোনা-পজিটিভ হওয়ার শোকে আত্মহত্যাও! অথচ এই সময়ে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে এর চেয়েও অনেক কম- ৮,৪৬২ জন। এ থেকেই বোঝা যায় আত্মহত্যার ব্যাপারে কতটা সচেতনতা জরুরি।

দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো অল্পবয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যাপ্রবণতা বাড়ছে

WHO-র ১৭ জুন ২০২১ তারিখের একটি ফ্যাক্ট শীটে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে পৃথিবীতে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর ৪র্থ বৃহত্তম কারণ ছিল সুইসাইড। অন্যদিকে জাতিসঙ্ঘ বলছে, আত্মহত্যা ১৪ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ!

বাংলাদেশেও বর্তমানে আত্মহত্যাকারীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের প্রায় ৫ শতাংশ একবারের জন্যে হলেও আত্মহত্যা করার চিন্তা করেছে। একবারের জন্যে হলেও পরিকল্পনা বা চেষ্টা করেছে ১.৫ শতাংশ মানুষ। আর যত মানুষ এখন সুইসাইড করছে তার প্রায় ৩৫ শতাংশই টিন-এজার বা অপ্রাপ্তবয়স্ক!

কিন্তু কেন?

প্রশ্ন হলো, জীবন যাদের এখনো ঠিকমতো শুরুই হলোনা, তারা কেন আত্মহত্যার মতো মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে?

অল্পবয়সীদের আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে শনাক্ত করেন তা মধ্যে আছে প্রেমে ব্যর্থতা, পারিবারিক অশান্তি ও বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, তিক্ত শৈশব, মাদকাসক্তি, মানসিক অসুস্থতা, সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব, ফিজিকেল ও সাইবার বুলিং।

আরো পড়ুন-

আরেকটি বড় কারণ হলো মানসিক ও আবেগিক ভারসাম্যহীনতা

আত্মহত্যা হতে পারে ইমপালসিভ; মানে কেউ তাৎক্ষণিক তাড়নায় বা কারো উপর রাগ-ক্ষোভ-অভিমান থেকে দুম করে সুইসাইড করে বসে। এই শ্রেণীর বেশিরভাগই হলো কিশোর ও তরুণ বয়সী।

আসলে এখনকার সময়ে এই বয়সীরা একটু বেশিই আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। বাবা-মা বা শিক্ষকের সামান্য বকুনিই হজম করতে পারে না অনেকে। প্রতি বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টের পর কিছু না কিছু শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর আসে। বেশিরভাগই খারাপ রেজাল্ট করায় বা কাঙ্ক্ষিত জিপিএ না পাওয়ায় বাবা-মায়ের বকাঝকার কারণে।

আবার অনেক ছেলেমেয়েই ভালো সুযোগ-সুবিধার মধ্যে বড় হয়, না চাইতেই পেয়ে যায় অনেক কিছু। ফলে প্রিয় কিছু চেয়ে না পেলে যে মানসিক আঘাত তারা পায় সেটাই তাদের প্ররোচিত করে আত্মহত্যা করতে। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হলো চলতি মাসের ১ তারিখে মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় শেরপুরে কলেজছাত্রের আত্মহত্যার ঘটনা।

মানসিক অসুস্থতা বা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাও একটি বড় কারণ। আত্মহত্যাপ্রবণদের শতকরা ৯০ ভাগই কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে বলে বলা হয়।

সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব

সুইসাইড গবেষণায় ‘কপিক্যাট ইফেক্ট’ নামে একটি শব্দ আছে। যখন কেউ সুইসাইড করে তখন অনেক সময় তার মতো মানসিক অবস্থা বা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে থাকা অন্য কেউ মনে করে এই অবস্থায় আত্মহত্যা-ই বুঝি সমাধানের একমাত্র পথ! অর্থাৎ সে আরেকজনের সুইসাইডকে কপি করে। এবং এ-ক্ষেত্রে একটি বড় দায় আছে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলোর।

এটা যে নিছক তত্ত্বকথা নয় তা বিগত বছরগুলোতে দেশ-বিদেশে সংঘটিত আত্মহত্যার কিছু ঘটনা থেকে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি।

প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদ বিশ্লেষণ থেকে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২০২০ সালে এবং ২০২১ সালের এখন (সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত অন্তত ১৬ জন ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, যাদের প্রায় ৯০ ভাগই বয়সে কিশোর বা তরুণ। এবং, দেখা যাচ্ছে যখন কেউ এভাবে আত্মহত্যা করছে তখন কাছাকাছি সময়ে একই রকমভাবে আত্মহত্যার আরো ঘটনা ঘটেছে।

অন্যদিকে বলিউডের তারকা অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পরপরই সেদেশে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যার আরো কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়।

আরো পড়ুন-

তাহলে এখন করণীয় কী?

সন্তানের আবেগিক বিকাশের দিকে নজর দেয়া জরুরি। ছোটবেলা থেকেই প্রয়োজনীয় শাসনটুকু থাকতে হবে। থাকতে হবে আদর-শাসনের ভারসাম্য। অতিরিক্ত শাসন যেমন অনুচিত, তেমনি উচিত নয় অতিরিক্ত আদর-আহ্লাদ। চাওয়ামাত্র সন্তানের সকল দাবি-দাওয়া মেটাবেন না, তাকে মাঝেমধ্যে অপেক্ষা করতে দিন।

আবার অনেক বাবা মা-ই তাদের অপূর্ণ স্বপ্নকে সন্তানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে চান। ভেবে দেখেন না এই চাওয়াটা সন্তানেরও কিনা। বা তা পূরণ করতে গিয়ে তার মনে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে কিনা। এরকম অমূলক প্রত্যাশা থেকে বেরিয়ে আসুন।

আর বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের আবেগীয় পরিবর্তনগুলোর দিকে মনোযোগ দিন। প্রায়ই মন খারাপ করে বসে থাকাকে স্রেফ ‘বয়সের দোষ’ না ভেবে কারণ খতিয়ে দেখাটাও কিন্তু আপনারই দায়িত্ব! আর তা তখনই সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন যখন আপনি তার এমন এক বন্ধু হবেন, যাকে মন উজাড় করে বলা যায় নিজের সবকিছু!

আরো পড়ুন-

কীভাবে বুঝবেন কেউ আত্মহত্যার কথা ভাবছে?

অনেক ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার ঘটনা সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফসল। অপ্রাপ্তি-হাহাকার-শূন্যতা-দুঃখ ইত্যাদি নেপথ্য কারণ হলেও মরমে আত্মহত্যার আকাংখা লালন করতে থাকেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। মধ্যবর্তী সময়ে তার কাজ বা আচরণে চিন্তার বহিঃপ্রকাশ থাকে, যা একটু খেয়াল করলেই বোঝা সম্ভব, সম্ভব তাকে এই পথ থেকে ফেরানোও।

এমন কয়েকটি লক্ষণ-

  • আচরণে অস্বাভাবিক পরিবর্তন, যেমন- চুপচাপ হয়ে যাওয়া, খেতে না চাওয়া, ঘুম না হওয়া ইত্যাদি;
  • একা থাকতে চাওয়া। ঘরে নিজের রুমে দীর্ঘক্ষণ দরজা বন্ধ করে থাকা;
  • পরিবারের কারো কাছে অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় আত্মহত্যা, মৃত্যু, চলে যাওয়া- ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে অনুভূতি প্রকাশ;
  • নিজের পছন্দের জিনিসগুলো অন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া;
  • নিজের প্রতি ঘৃণার কথা বলা বা নিজেকে আঘাত করা;
  • আত্মহত্যার প্রক্রিয়া নিয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করা বা সরঞ্জাম যোগাড়ের চেষ্টা করা।

আপনার কিছু কাজ হয়ত কাছের মানুষটিকে বাঁচিয়ে দেবে আত্মহত্যা করা থেকে

যদি প্রিয়জনের মধ্যে আত্মহত্যাপ্রবণতার লেশমাত্রও দেখে থাকেন তাহলে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিন। মনস্তত্ববিদ ও আত্মহত্যা বিষয়ক গবেষকদের বরাতে এমন কিছু করণীয়:

  • ব্যঙ্গবিদ্রুপ নয়, প্রয়োজন কথার গুরুত্ব:

‘আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না, বা আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে’- সন্তান বা প্রিয়জনের মুখে বা ফেসবুক পোস্টে এমন কথাকে স্রেফ ‘কথার কথা’ বা আবেগ বলে উড়িয়ে দেবেন না। অনেক ক্ষেত্রেই যখন এই ধরণের কথাবার্তাকে আশপাশের মানুষ পাত্তা দেয় না, বা তাকে ‘অ্যাটেনশন সিকার’ বলে বিদ্রুপ করে তখন সেই ছেলে বা মেয়েটির মধ্যে জেদ চেপে বসতে পারে তার কথাকে প্রতিষ্ঠিত করার। আর তা সম্ভব কেবল আত্মহত্যার মাধ্যমে!

আর সন্তান যদি আগেও আত্মহত্যাচেষ্টা করে থাকে তাহলে তার প্রতি বিশেষ নজর দিন। কারণ গবেষণা বলছে, যাদের আত্মহত্যাচেষ্টার ‘অতীত’ আছে তাদের পুনরায় আত্মহত্যাচেষ্টার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ৬ গুন!

  • মমতা ও মনোযোগ দিন:

আত্মহত্যাকারীদের বেশিরভাগই নিজেদের নিঃসঙ্গ মনে করে। দুনিয়ায় তাকে আর কারো প্রয়োজন নেই, বা তার বেঁচে থাকাটা অপ্রয়োজনীয়- এমন ভ্রান্তধারণা নিয়ে বুকচাপা অভিমানের সাগরে নিমজ্জিত এই মানুষগুলোর প্রতি মনোযোগ দিন; আপনার বুকভরা মমতা দিয়ে তাকে অনুধাবন করতে দিন, আর কিছু না হলেও অন্তত আপনার জীবনে তার প্রয়োজন আছে!

  • প্রযোজ্য ক্ষেত্রে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন:

তবে তার মনোবেদনার কারণ যদি হয়ে থাকে বিষণ্নতা বা অন্য কোনো মানসিক রোগ তাহলে চিকিৎসার প্রয়োজন আছে। আসলে মানসিক রোগ কোনো লোকলজ্জার বিষয় নয়; এটাও এক প্রকার অসুস্থতা, যার নিরাময় আছে এবং নিরাময় হওয়াটা জরুরি।

তাই বেরিয়ে আসুন মানসিক রোগকে লুকিয়ে-ছাপিয়ে রাখার সোশ্যাল ট্যাবু থেকে। তাকে নিয়ে শরণাপন্ন হোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের। মানসিক রোগভেদে প্রযোজ্য মেডিকেশন, কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি নিয়ে সুস্থ সফল সুখীজীবন যাবন করছেন, এমন মানুষ আছে অসংখ্য!

  • একাত্ম করুন মেডিটেশন ও সৎসঙ্ঘে:

সন্তান বা প্রিয়জনকে মেডিটেশন এবং সৎসঙ্ঘের সঙ্গে পরিচিত করান। মেডিটেশন মানুষকে আত্মবিশ্বাসী, প্রশান্ত ও সমমর্মী করে। নিজেকে ভালবাসতে শেখায়। আর সৎসঙ্ঘ তাকে দেবে জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য, কল্যাণের লক্ষ্যাভিসারী।

তাই তাকে নির্দ্বিধায় নিয়ে আসুন কোয়ান্টামে। ৪ দিনের কোয়ান্টাম মেথড কোর্স এবং সাদাকায়ন, আলোকায়ন, আলোকিত পরিবার কার্যক্রমের মতো উন্মুক্ত নানা প্রোগ্রামে। আপনার এই সামান্য কাজটুকুই তার জীবনে রাখতে পারে অসামান্য অবদান, তাকে মুক্ত করতে পারে হতাশা বিষাদ আর আত্মহত্যাপ্রবণতা থেকে।

আরো পড়ুন-