রমজানে মানসিকভাবে ফিট থাকতে করুন এই ৫ কাজ

রমজানে শারীরিক ফিটনেস বৃদ্ধির ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষই সচেতন। এসময়ে সচেতন মানুষ অতিরিক্ত ভাজা পোড়া বর্জন, গুরুপাক খাবার না খাওয়া বা অতিরিক্ত চিনিযুক্ত শরবত বা ড্রিংক্সের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে থাকেন।

তবে রমজানের শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অনেকেরই নজর এড়িয়ে যায়। আর তা হলো মানসিক ফিটনেস।

রমজানে ইবাদতের মাধ্যমে পরম করুণাময় স্রষ্টার নৈকট্য লাভের জন্যে মানসিক ফিটনেসের গুরুত্ব অপরিসীম।

তবে চলুন জেনে নেয়া যাক এমন ৫টি কাজ যা এই রমজানে আপনাকে করবে মানসিকভাবে আরো বেশি ফিট।

১. মেডিটেশন চর্চা

মেডিটেশনের এক নম্বর উপকার হচ্ছে ফিজিক্যাল ফিটনেস। দুই নম্বর হচ্ছে, মেন্টাল ফিটনেস।

মেডিটেশন কীভাবে মেন্টাল ফিটনেসে সাহায্য করে?

মেডিটেশন মানসিক প্রশান্তি সৃষ্টি করে।

মেডিটেশনের প্রাথমিক প্রাপ্তি হচ্ছে প্রশান্তি। এবং প্রশান্ত মনই মানসিক শক্তি এবং মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।

যেকোনো পরিস্থিতিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতা একজন মেডিটেশন চর্চাকারীর অনেকটা সহজাত।

আমরা অধিকাংশ সাধারণ মানুষই কোনো ঘটনা ঘটা মাত্রই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ফেলি।

ভালো কিছু হলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। আবার খারাপ হলে বলি, হায়রে কপাল! আরেকজনের কটু মন্তব্যে আমরা নিজেকে গুটিয়ে নেই।

কিন্তু আমরা অপেক্ষা করতে পারি না যে, প্রত্যেকটা মন্দের পেছনে ভালো দিক আছে। সেই ভালো দিকটা প্রকাশিত হওয়ার জন্যে যে সময় দেয়া দরকার এই সময়টা আমরা দিতে পারি না আমাদের মেন্টাল ফিটনেসের অভাবের কারণে।

যিনি মেডিটেশন চর্চা করেন, তিনি যেকোনো চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে প্রজ্ঞার সাথে সঠিক কাজটি করতে পারেন। যেখানে অধিকাংশ মানুষই হয়তোবা রাগের মাথায় হঠকারী কিছু করে ফেলেন যা পরবর্তীতে তার নিজের জন্যেই অকল্যাণকর।

গবেষণায় দেখা গেছে, ধ্যান বা মেডিটেশন শরীরের ‘স্ট্রেস রিএকশন’ কে বিঘ্নিত করে। ফলে যেসব ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ রিএক্ট করেন, একজন ধ্যানী সেই ক্ষেত্রে রাগ ক্ষোভ হিংসা ঈর্ষা দমন করে প্রো এক্টিভিটির পরিচয় দিচ্ছেন।

২. ইবাদতে দীর্ঘক্ষণ মনোনিবেশ করা

রমজান ইবাদতের শ্রেষ্ঠ সময়।

এসময় অপ্রয়োজনীয় কথা কাজ আচরণ থেকে দূরে থেকে যত বেশি সম্ভব ইবাদতে মশগুল হওয়াই শ্রেয়।

রমজানে রাসূল (সা) কোরআন চর্চার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন (ছবিসূত্রঃwww.banglanews24.com)

রমজানে ইবাদতের মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় কোরআনের জ্ঞান চর্চার কথা।

ইরানের জাহেদান ইউনিভার্সিটি অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস এ দুটো দলে সংঘটিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে দলটি কোরআন শ্রবণ করেছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটেছে এবং মনকে তারা শান্ত ও স্থির রাখতে পারছেন।

গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে যে মনোবিজ্ঞানীরাও রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যে কোরআন চর্চা পরামর্শ করতে পারেন!

৩. গীবত থেকে বিরত থাকা

কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়।

এমন একটি কাজ যা আপনার রোজা নষ্ট করে দিতে পারে এমনকি যেই কাজটি করলে নামাজ এবং রোজার কাজা আদায় করতে হয় তা হলো গীবত।

গীবতের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি।

গীবতকারী স্বয়ং স্রষ্টার কাছেই এত অপছন্দনীয় যে গীবতকারীর দোয়া পর্যন্ত তিনি কবুল করেন না!

গীবত আপনার সকল সৎকর্ম নষ্ট করে দিতে পারে।

তাছাড়া গীবত করতে যতই মজা লাগুক না কেন, গীবত করার পরের অনুভূতিটা মোটেই সুখকর নয়। অস্থিরতা, অনুশোচনায় অন্তর যখন ছেয়ে যায়, মানসিক ফিটনেসের জন্যে যা মোটেই ইতিবাচক কিছু নয়।

একদিন দুদিন করতে করতে গীবত একটা নেশায় পরিণত হয়ে যায়।

তবে এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

প্রথমত, গীবত থেকে বাঁচার জন্যে অন্যের দোষ ধরার প্রবণতা বাদ দিতে হবে।

আসলে নিজের দিকে তাকালে উপলব্ধি করতে পারব যে নিজের এতো দোষ যে অন্যের দোষ দেখবো কখন! যদি অন্যের দিকে না তাকিয়ে নিজের দিকে তাকাতে পারি তাহলে ৯৫% গীবত কমানো সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, যখন কোথাও কারো সম্পর্কে গীবত হবে তখন সেখান থেকে সরে যেতে হবে। আর যদি সরে যাওয়ার সুযোগ না থাকে যার সম্পর্কে গীবত করা হচ্ছে তার সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বলুন।

তৃতীয়ত, কারো প্রতি ঈর্ষার কারণে যদি গীবত করা হয় তাহলে ঈর্ষা থেকে মুক্ত হতে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করতে হবে। তার কল্যাণ কামনা করতে হবে।

চতুর্থত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা করবেন তা হলো, গীবতকারীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন!

৪. চর্চা করুন ডিজিটাল ফাস্টিং

ডিজিটাল ফাস্টিং’ হলো গ্যাজেট ব্যবহার থেকে সচেতনভাবে কিছু সময়ের জন্যে নিজেকে নিবৃত্ত রাখা। রমজানে ফুড ফাস্টিংয়ের পাশাপাশি ডিজিটাল ফাস্টিং চর্চা আপনার মানসিক ফিটনেসকে উন্নীত করবে এক নতুন স্তরে।

বর্তমানে গ্যাজেটস এবং ডিভাইস আসক্তি কেড়ে নিয়েছে আমাদের অমূল্য সময়, মনোযোগ, পারিবারিক সম্প্রীতি।

রমজানে ফুড ফাস্টিংয়ের পাশাপাশি ডিজিটাল ফাস্টিং চর্চা (ছবিসূত্রঃimobilecool.blogspot.com)

এমনকি এই ডিভাইস আসক্তি আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত সময়টাতেও হস্তক্ষেপ করছে, তা হলো ঘুম!

জ্বী, পাঠক!

শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো দৈনিক পর্যাপ্ত ঘুম। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্যে প্রতি রাতে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট।

আর একজন মেডিটেশন চর্চাকারীর জন্যে দৈনিক ৪ ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট!

তবে এই স্লিপ সাইকেলে গড়মিল লেগে যায় যখন বিছানায় যাবার সময়ও আপনার হাতে থাকে স্মার্টফোন।
সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ দিনে জেগে থাকা এবং রাতে ঘুমানোর জন্যে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রোগ্রামড।

রাতে যখন আমরা বিছানায় স্মার্টফোন নিয়ে যাই, ফোনের উজ্জ্বল নীল আলোয় মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হয়ে যায়। সে তখন এই আলোকে ফোনের আলো না ভেবে দিনের সূর্যের আলো ভেবে ভুল করে!

ফলে মস্তিষ্ক তখন মেলাটনিন হরমোন নিঃসরণ কমিয়ে দেয়, যা কিনা শরীরকে ঘুমানোর জন্যে প্রস্তুত করে।

এজন্যেই ঘুম ঘুম চোখে বিছানায় গেলেও একবার ফোন হাতে নিলে ঘুম পালিয়ে যায়।

দীর্ঘদিন এই অভ্যাসের ফলে স্লিপ সাইকেল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং ফলাফল স্বরূপ ডিপ্রেশন, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, কর্মক্ষমতা নষ্ট হওয়া, মনোযোগ বিক্ষিপ্ততা হতে পারে আপনার নিত্যসঙ্গী।

গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে আরো ভয়াবহ তথ্য!

রাতে স্মার্টফোনের নীলচে আলো অপর্যাপ্ত ঘুমের জন্যে দায়ী যা ব্রেস্ট ক্যান্সার এবং প্রস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে!

তাই আজ থেকেই শুরু করুন ডিজিটাল ফাস্টিং।

রাত ১১টা বাজতেই সব ধরণের স্ক্রিন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করুন।

আর, সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই স্মার্টফোনে চোখ মেলার অভ্যাস থাকলে তা ছাড়ুন এখনই।

কিছুদিন চর্চা করলে আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে এবং আপনার হারিয়ে যাওয়া মানসিক ফিটনেস আবারো ফিরে আসবে।

৫. বিনোদনে থ্রিলার কন্টেন্ট পরিহার করুন

রগরগে থ্রিলার বা ডিটেকটিভ নাটক উপন্যাস মুভি সিরিজ কার না পছন্দ!

এমনকি হাল আমলে নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম, চরকি, হইচইতে সবথেকে বেশি দর্শকপ্রিয় কন্টেন্টগুলো থ্রিলার ঘরানার।

পরিমিতির বজায় রেখে মাঝেসাঝে এসব দেখাই যায়।

তবে বিপত্তিটা বাধে তখন যখন আপনি খুব বেশি পরিমাণে থ্রিলার কন্টেন্টে ডুবে যাবেন।

কীভাবে?

কোনো ধরনের বিপদ, ক্ষতি বা স্ট্রেসের সম্মুখীন হলে আমাদের শরীরে এড্রেনালিন হরমোন নিঃসরণ হয়। এড্রেনালিন হরমোন আপনাকে শারীরিকভাবে এই বিপদ মোকাবেলা করার জন্যে প্রস্তুত করে।

বিনোদন হিসাবে থ্রিলার মুভি বা উপন্যাস পরিহার করুন (ছবিসূত্রঃwww.deviantart.com)

আমরা যখন কোনো থ্রিলার সিরিজে ভীতিকর বা রোমহর্ষক দৃশ্য দেখি, মস্তিষ্ক তখন একে বাস্তব বলে মনে করে শরীরে এড্রেনালিন হরমোন নিঃসরণ করে। যার ফলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, মস্তিষ্ক ও পেশিতে রক্ত চলাচল বেড়ে যায়, শরীরে ঘাম হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, খুব ঘন ঘন এড্রেনালিন রাশ হলে হৃদপিণ্ডের পেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে এমনকি হৃদরোগীদের হতে পারে হার্ট অ্যাটাক!

ক্রমাগতভাবে স্ট্রেস হরমোন নিঃসৃত হলে মস্তিষ্কের যেই অংশ স্মৃতি ধরে রাখে অর্থাৎ হিপ্পোক্যাম্পাস, তা আকারে ছোট হয়ে যায়। ফলে স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ বেড়ে যায়, ধমনীতে প্লাক তৈরি হয় এবং সার্বক্ষণিক উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা অনুভূত হয়।

তাই নিজেকে মানসিকভাবে ফিট রাখতে যথাসম্ভব থ্রিলার বা মানসিক চাপ তৈরি করে এমন কন্টেন্ট থেকে দূরে থাকুন।

একান্তই দেখতে হলে ইতিবাচক কন্টেন্টই থাকুক বিনোদনের ক্ষেত্রে আপনার পছন্দের তালিকায়!