published : ৪ মার্চ ২০২৫
আপনি রোজা রেখেছেন। বিকেল হতেই ক্ষুধায় আপনার মেজাজ গরম হয়ে যায়। আশেপাশের লোকেরা বলল, “ওনার কাছে যেও না, ওনাকে রোজায় ধরেছে!” এমনটা হলে বুঝবেন, সংযম রক্ষায় আপনি ব্যর্থ হয়েছেন!
আসলে প্রকৃত রোজা সবসময়ই আপনাকে প্রশান্ত করবে। রোজার সময় যত গড়াতে থাকবে মন তত শান্ত হতে থাকবে।
রমজানের আরবি প্রতিশব্দ সাওমের (বহুবচনে সিয়াম) আক্ষরিক অর্থই হলো ‘সংযম’। ভোজন কমবে, ঝরবে বাড়তি ওজন, কমবে খরচ, পরিশুদ্ধ হবে দেহমন, পালন হবে সামাজিকায়ন- এটাই সংযমের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি।
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে-কোনো খাবার, পানীয়, ধূমপান এবং শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকতে হবে যাতে আপনার দেহ অভ্যন্তরীণ আবর্জনা ও বিষাণু থেকে মুক্ত হয়ে ঝরঝরে ও প্রাণবন্ত হয়।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা), আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস- রোজা রাখো, যাতে তোমরা সুস্থ থাকতে পারো। (তাবারানী)
এই সুস্থতা শারীরিক-মানসিক-সামাজিক-আত্মিক। অর্থাৎ, সার্বিকভাবে যেন আপনি ভালো থাকতে পারেন সেজন্যেই রমজান মাসের এত গুরুত্ব।
রমজানে মানুষকে মন্দ কথা বলা, গালি দেয়া, মিথ্যা বলা এবং নেতিবাচক কথা ও আচরণ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এটা বাকসংযমেরই প্রকাশ।
আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রসুল (স) বলেছেন : একজন মহিলা নামাজ-রোজা পালন ও দানশীলতার জন্যে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তার তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে প্রতিবেশীরা জর্জরিত ছিল। নবীজী (স) তাকে জাহান্নামের অধিবাসী হিসেবে অভিহিত করলেন। এর বিপরীতে আরেকজন মহিলাকে জান্নাতের অধিবাসী হিসেবে অভিহিত করলেন, যে কোনো নফল নামাজ পড়ত না, কিন্তু প্রতিবেশীদের সাথে সদ্ব্যবহার করত। (মুফরাদ, আহমদ, বায়হাকি)
আরেকটি হাদীস হলো, রোজাদার যদি মিথ্যাচার ও অশোভন কাজ পরিহার না করে, তবে তার পানাহার বর্জন আল্লাহর কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না।
—আবু হুরায়রা (রা); বোখারী
পবিত্র এই মাসে শুদ্ধমনে ইবাদত ও সৎকর্ম করা উচিৎ। অশ্লীল চিন্তা, অহংকার, ঈর্ষা, গীবত, মিথ্যা আশা বা অন্যের ক্ষতি চাওয়ার মতো নেতিবাচক ভাবনা থেকে মুক্ত থাকার ব্যাপারেও তাগিদ দেয়া হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস হলো- গীবত নামাজ ও রোজা নষ্ট করে দেয়। গীবত করলে পুনরায় নামাজ আদায় করো ও পরে কাজা রোজা রাখো। (মেশকাত)
রমজান পুরোটাই সৎকর্মের মাস। আপনার যা-কিছু পুণ্য, সওয়াব, নেকি আপনি অর্জন করছেন, গীবত করলে আখেরাতে আপনি দেউলিয়া হয়ে যাবেন। অর্থাৎ, যা সওয়াব অর্জন করেছেন সেগুলো দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে করতে আপনার নেকী বলতে থাকবে না কিছুই।
তাই সচেতনভাবে গীবত বলা, শোনা, দেখা ও পড়া থেকে বিরত থাকুন।
আসলে শুধু নির্দিষ্ট সময় পানাহার বর্জনই রোজা নয়। রাগ ক্রোধ ক্ষোভ হঠকারিতা বা অযথা তর্ক-বিতর্ক করাসহ প্রতিটি ক্ষতিকর আবেগকে সংযত রাখার নাম হচ্ছে রোজা।
আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীস হলো- আল্লাহ বলেন, মানুষের প্রতিটি আমল বা কাজ হচ্ছে তার নিজের জন্যে। আর রোজা হচ্ছে কেবল আমার জন্যে। (আমার জন্যেই সে খাবার ও পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকে এবং যৌন কামনা-বাসনাকে সংযত করে।) তাই রোজার পুরস্কার আমিই তাকে দেবো। রোজা হচ্ছে (পাপাচার ও জাহান্নামের আগুনের বিরুদ্ধে) বর্ম। অতএব তোমরা যখনই রোজা রাখো, তখন ফালতু আজেবাজে অপ্রয়োজনীয় কথা বলবে না, চেঁচামেচি করবে না। কেউ গালি দিলে বা ঝগড়া করতে এলে বলবে, আমি রোজাদার। (বোখারী, মুসলিম)
তাই ক্ষতিকর আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সদাচারি ও সংযমী হয়ে উঠুন। এই সংযমী ভালো আচরণ ও সমমর্মিতাই আপনাকে এতেকাফের চেয়েও অনেক গুণ বেশি সওয়াবের অধিকারী করতে পারে।
রমজানে অতিরিক্ত ঘুমানো, অযথা শুয়ে বসে সময় নষ্ট করা এবং টেলিভিশন/স্মার্টফোন/ল্যাপটপের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর বিষয়বস্তুর প্রতি মনোযোগ দেয়া থেকেও বিরত থাকুন।
আপনি যদি রোজাকালীন সময়ে মুভি/নাটক দেখে, ইনস্টাগ্রামে রিলস দেখে, ফেসবুক স্ক্রল করে সময়টাকে নষ্ট করেন তাহলে আপনার এই রোজা অর্থহীন।
তাই সময় অপচয়ের বদলে নামাজ, মেডিটেশন, কোরআনের জ্ঞান অর্জন এবং দান-সদকার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করুন পুরো রমজান।
চিন্তা করুন সেই অসহায়দের কথা, যারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক মুঠো ভাতের জন্যে কান্না করছে। যারা সেহেরিতে না খেয়ে থাকলেও চাইতে পারবে না আত্মসম্মান হারানোর ভয়ে। যারা দিন আনে দিন খায়, কাজ না থাকলে যাদের ঘরে ভাত থাকে না, তাদের কথা ভেবে সমস্ত বাহুল্য বর্জন করুন। বর্জন করুন ইফতার পার্টি, সেহেরি পার্টির মতো ভ্রষ্টাচারগুলো।
খাবার-দাবারে খরচ কমিয়ে নিজেদের জন্যে তিন আইটেম বরাদ্দ করুন। ঈদে কেনাকাটার খরচ থেকেও টাকা বাঁচিয়ে কারো অভাব মোচন করুন, কারো মুখের খাবার যোগান, আন্তরিকভাবে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। দেখবেন, রমজানের এই দান আপনাকে কতটা প্রশান্তি এনে দেয়!