
published : ৫ ডিসেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশে কোয়ান্টামই একমাত্র সঙ্ঘ যা ভ্রুণ থেকে শুরু করে কবর পর্যন্ত সেবা দিয়ে চলেছে। এখানে মাতৃমঙ্গল সেবা প্রকল্পের মাধ্যমে দুঃস্থ নারীদের গর্ভকালীন পুষ্টি ও চিকিৎসা যেমন দেয়া হয়, তেমনি দাফনসেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্মানজনক শেষ বিদায় জানানো হয় তাদের, অর্থাভাবে যাদের পরিবার এই কাজটি করতে পারে না।
তবে ফাউন্ডেশন আর দশটা সেবা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তিক্রমী এখানেই যে, এই সেবাকাজগুলো পরিচালিত হয় স্বেচ্ছাসেবীদের অংশগ্রহণে।
স্বেচ্ছাসেবার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানুষের চেনা-জানারবৃত্তকে ভাঙা। ৩৩ বছর কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে এই বৃত্তগুলো ভাঙার কাজটাই করছে নীরবে।
প্রতিটি মানুষই ইউনিক, আলাদা। পছন্দ, আগ্রহ, দৃষ্টিভঙ্গিও আলাদা। স্বেচ্ছাসেবায় আগ্রহের জায়গাটা তাই পৃথক হতেই পারে!
কারো ভালো লাগতে পারে বছরজুড়ে মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করতে; কারো হয়ত টানবে শীত, বন্যা বা বড় কোনো দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিক ত্রাণ বিতরণ। অনেকের আগ্রহ থাকে প্রচুর মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত কার্যক্রমে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। কারো আবার ত্রাণের পণ্য প্যাকেটজাতের মতো নীরব সেবাকাজই পছন্দ।
এত বিস্তৃত/বহুমুখী পছন্দের মানুষদের স্বেচ্ছাসেবায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হলে একটি প্রতিষ্ঠানের কত ধরণের সেবা প্রকল্প থাকতে হবে আপনিই ভাবুন! আমরা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বলতে পারি, কোয়ান্টামে এই ব্যাপক সুযোগটি রয়েছে।
কোয়ান্টামের অসংখ্য সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীর সম্মিলিত স্বেচ্ছাসেবায় পরিচালিত হচ্ছে এরকম ৩৬টি সেবাকাজ।
ঘটনা-১
এখন পর্যন্ত যে প্রায় ৫৮ হাজার দুঃস্থ প্রসূতি মাতৃমঙ্গলের সেবা নিয়ে সুস্থ সন্তানের মুখ দেখেছেন, তাদের একজন সকিনা আক্তার। এর আগে পরাপর দুই সন্তান গর্ভে মারা যাওয়ায় ভেঙে যায় তার প্রথম সংসার। দ্বিতীয় বিয়ের পর মারা যায় তার ৩য় সন্তান।
চতুর্থবারে একপ্রকার মরীয়া হয়েই কোয়ান্টামে এসেছিলেন তিনি। কারণ এই সন্তান মারা গেলে ভেঙে যাবে তার সংসার।
মাতৃমঙ্গল সেবার আওতায় গর্ভকাল থেকে শুরু করে সন্তান জন্মদানের ৪০ দিন পর্যন্ত প্রসূতিকে বিনামূল্যে দেয়া হয় পুষ্টিকর খাবার, ওষুধ ও চিকিৎসা সেবা। এর বাইরেও সকিনার প্রয়োজন ছিল ৪,৫০০/- টাকার বাড়তি ওষুধ ও ইনিজেকশনের। এটাও দিয়েছে কোয়ান্টাম।
মাতৃমঙ্গলের এই বিশেষ সহায়তা নিয়ে তিনি জন্ম দিয়েছেন ফুটফুটে সন্তান। হাসপাতালে তার সিজার অপারেশন এবং পোস্ট-অপারেটিভ কেয়ারের সময়টাতেও সার্বক্ষণিক তার পাশে ছিল একজন কোয়ান্টাম কর্মী।
ঘটনা-২
ঢাকা মেডিকেলের একজন তরুণ ডাক্তারকে নাড়িয়ে দিয়েছিল ১৯৯৩ সালের এক করুণ ঘটনা। ভাই বোন দুজনই থ্যালাসেমিয়া রোগী। দুজনকেই নিয়মিত রক্ত দিতে হয়।
একবার এমন হলো, রক্ত নেয়ার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। একদিন দুইদিন করে সময় যাচ্ছে, ডোনার মিলছে না। দুজনের অবস্থাই রক্তের অভাবে করুণ হতে শুরু করল।
এই অবস্থায় তরুণ ডাক্তার একজন ডোনার পেলেন, যার রক্তের গ্রুপের সাথে তাদের মিল আছে। তিনি তাৎক্ষণিক রক্ত দিলেন। কিন্তু রক্ত এক ব্যাগ, গ্রহীতা দুজন- ডাক্তার কাকে রক্ত দেবে?
বোনের অবস্থা বেশি খারাপ। কিন্তু তাকে রক্ত দিতে গেলে সে বলল ভাইকে আগে দিতে। ভাইকে রক্ত দেয়া হলো এবং তার অবস্থা ভালো হলো। কিন্তু আর কোনো ডোনার পাওয়া গেল না, রক্তের অভাবে মারা গেল মেয়েটি।
কোয়ান্টাম সদস্যদের নিয়ে স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম শুরু করে ১৯৯৫ সালে। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কোয়ান্টাম ব্লাড ল্যাব। বর্তমানে দেশে মোট রক্তচাহিদার ৫ ভাগের ১ ভাগ এখন মেটাচ্ছে কোয়ান্টাম। এখন পর্যন্ত সতের লক্ষাধিক ইউনিট রক্ত ও রক্ত উপাদান দিয়ে কোয়ান্টাম সাহায্য করেছে অগণিত মানুষের জীবন বাঁচাতে। থ্যালাসেমিয়াসহ গুরুতর যেসব রোগীদের নিয়মিত রক্ত লাগে, কিন্তু অর্থাভাবে প্রসেসিং খরচ দিতে পারে না, কোয়ান্টাম তাদের রক্ত সরবরাহ করে বিনামূল্যে।
কোয়ান্টামের সরবরাহকৃত রক্তে সুস্থ হয়ে ওঠা এই দুঃস্থ রোগীদের হাসিমুখ দেখে সেই দিনটা সামনে ভেসে ওঠে কোয়ান্টাম রক্তদান কার্যক্রমের স্বেচ্ছাসেবক সেই ডাক্তারের। সেদিন সময়মত আর একটা ব্যাগ রক্ত পাওয়া গেলেই হয়ত বাঁচান যেত সেই মেয়েটিকে!
ঘটনা-৩
করোনার শুরুর দিকে যখন আতঙ্কে মানুষ প্রিয়জনের লাশ ফেলে পালাচ্ছিল, সেসময় সঙ্ঘের আহ্বানে যে শত শত কোয়ান্টাম সদস্য অকুতভয়ে স্বেচ্ছা দাফন কার্যক্রমে এগিয়ে আসে তাদের একজন নয়ন (ছদ্মনাম)।
একবার তাদের টিম ফোন পায় এক ব্যাক্তির লাশ দাফনের জন্যে। জীবদ্দশায় যার ছিল ধনেজনে সমৃদ্ধ প্রতিপত্তির জীবন, অথচ করোনায় মারা যাওয়ার পর তার ধারেকাছেও নেই কেউ। দিনের পর দিন ঘরের মধ্যেই পচেছে তার লাশ! শেষ পর্যন্ত এই শতকোটিপতি মানুষটির দাফন কাফন হয়েছে স্বেচ্ছাসেবায়, দাতার অর্থে।
জীবন কতটা ঠুনকো, সম্পদই জীবনের সব নয় এই উপলব্ধি সেদিন হয়েছিল নয়নের।
আসলে জীবনকে কাছ থেকে দেখার, মানুষের প্রয়োজনকে বোঝার সুযোগ করে দেয় এই সেবা কার্যক্রমগুলোতে স্বেচ্ছাসেবায় অংশগ্রহণ। প্রত্যেক স্বেচ্ছাকর্মীরই রয়েছে এমনসব অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি।
সেবার ব্যাপারে কোয়ান্টামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো- জাতিধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে মানুষকে সহয়তা করা। I can serve. অর্থাৎ আমি সেবা দিতে পারি, নিজের এবং অন্যের প্রয়োজন পূরণ করার সক্ষমতা আমার রয়েছে- এটাই সেবার মূলমন্ত্র।
অনেকেই ভাবেন—“আমার ছোট সহায়তা দিয়ে কী হবে?” আসলে অনেক কিছুই সম্ভব যার দৃষ্টান্ত কোয়ান্টাম। এখানে মেধা শ্রম অর্থ সময় যে-কোনোকিছু দিয়েই সেবার সুযোগ রয়েছে। এখানে স্বেচ্ছাসেবা করার জন্যে অনেক কিছুর প্রয়োজন নেই, শুধু প্রয়োজন আপনার ইচ্ছা, সময় এবং আন্তরিক ভালবাসা। অল্পায়াসে ব্যাপক মানবকল্যাণ এবং আত্মনির্মাণের চমৎকার সুযোগ কোয়ান্টামেই সম্ভব!
একজন কোয়ান্টাম সদস্যের মনছবি ছিল মহাকাশবিজ্ঞানী হবেন। এজন্যে যে সাবজেক্টে পড়তে হবে তা দেশে পড়ানো হয় না। অতএব, পড়তে যেতে হবে বিদেশের ভালো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং তার জন্যে লাগবে স্কলারশীপ। ফুল স্কলারশীপ তিনি পেলেনও; তবে বাঁধ সাধল স্কলারশিপের একটা শর্ত- ক্যান্ডিডেটের সোশ্যাল একটিভিটিসের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে!
সৌভাগ্যক্রমে তিনি ছিলেন কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের কোয়ান্টিয়ারের। এই কাজে তার ৪ বছরের অভিজ্ঞতাকে তিনি উল্লেখ করেছিলেন স্কলারশীপ প্রসেসিংয়ে।
আসলে অনেক শিক্ষার্থীই কোয়ান্টামে স্বেচ্ছাসেবা করে শিক্ষাজীবনে উপকৃত হয়েছেন। কারণে তাদের জ্ঞান শুধু পাঠ্যপুস্তকেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বাস্তব জ্ঞানও তাদের হয়ে যায় এই কাজগুলোর মধ্য দিয়ে। স্বেচ্ছাসেবার মধ্য দিয়ে তারা খুঁজে পান জীবনের লক্ষ্য আর সেই লক্ষ্য অর্জনের মোটিভেশন।
পেশাজীবনেও স্বেচ্ছাসেবার অভিজ্ঞতা অনেক সহায়ক হতে পারে। কারণ এই কাজগুলোর মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠবে আপনার ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতা (managerial capacity); আপনি আয়ত্ত্ব করবেন সময় ব্যবস্থাপনা (time management), ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা (People Management) দক্ষতা এবং নেতৃত্বগুণ” (Leadership Skills)
সারা দেশে আমাদের রয়েছে দুই শতাধিক সেন্টার-শাখা-সেল। এর যে-কোনোটিতে গিয়ে আপনি আপনার স্বেচ্ছাসেবার আগ্রহ ব্যক্ত করলে সেখান থেকেই ব্যবস্থা করে দেয়া হবে স্বেচ্ছাসেবার। ৪ দিনের কোর্স করার মাধ্যমে গ্রাজুয়েট সদস্য হতে পারলে খুব ভালো। না হলেও ক্ষতি নেই! রেজিস্টার্ড এসোসিয়েট হয়েও অংশ নিতে পারবেন এই সেবায়।
তাই আসুন, কোয়ান্টামে স্বেচ্ছাসেবার এই অনন্য সুযোগটি গ্রহণ করে হয়ে উঠি কারো জীবনের দ্যুতি!