published : ২৭ জুন ২০২২
ঘনিয়ে আসছে কোরবানির ঈদ, পসরা সাজিয়ে বসতে শুরু করেছে ভোগ্যপণ্যের শো-রুমগুলো। চটকদার বিজ্ঞাপনে বিপণনের ‘পরীক্ষিত’ হাতিয়ার Equal Monthly Installment (EMI)। মানে আগে ঘরে তুলবেন পণ্য, এরপর ১২/১৮/২৪/৩৬টি সমান মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করবেন এর দাম।
কনজ্যুমার লোন তথা ভোগ্যপণ্য কেনার ঋণদাতারাও দিচ্ছেন আকর্ষণীয় অফার। আর সাধারণ মানুষও হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কেনাকাটায়। টিভি ফ্রিজ ওভেন ইত্যাদি ধুমসে বিক্রির ‘মৌসুম’ তো এখনই!
মানুষের একটি সাধারণ মনস্তত্ত্ব হলো, যখন নগদে কেনে তখন সে বাছবিচার করে কোনটা কিনবে আর কোনটা কিনবে না। কিন্তু ব্যাপার যদি এমন হয় যে, এখনই পুরো মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে না, তাহলে সে কেনে বেশি! এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্যটিও কিনে ফেলে অবলীলায়!
সাধারণ মানুষের এই ‘সাধারণ’ মনস্তত্ত্বকেই অসাধারণভাবে কাজে লাগাচ্ছে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা! ইএমআই-এ বেচাবিক্রির দিকে তাই এত ঝোঁক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর পর কনজ্যুমারিজমের বিকাশ ঘটতে থাকে; এতে বেড়ে যায় ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন। কিন্তু এককালীন বড় অংকের অর্থব্যয় করে পণ্য কেনার ব্যাপারে ক্রেতাদের অনীহা থাকায় বিপাকে পড়ে মুনাফাখোর বেনিয়ারা। তারা তখন দেখল, যদি ক্রেতাকে বাকিতে কেনার সুযোগ করে দেয়া হয়, মানে ‘দাম পরে দিলেও হবে’ এই চিন্তাটা যদি তার মধ্যে ঢোকানো যায় তাহলে সে তার সামর্থ্যের বাইরেও কিনবে।
হয়েছেও তা-ই! এককালীন নগদ অর্থে ৫০ হাজার টাকার ফ্রিজ কেনার সামর্থ্য যার নেই সেও লাখ টাকা দামের ফ্রিজ কিনছে ইএমআই ‘সুবিধা’ থাকায়।
‘মাসে মাসে তো আর কিনছেন না, একটু বেশি দামে ভালোটা কেনাই তো ভালো!’- সেলসম্যানের মিষ্টি কথায় গলে গিয়ে সামর্থ্যের চেয়ে বেশি দামের পণ্য কিনে ঘরে তুলছে মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষও। পরিণামে পড়ছে কিস্তির ফাঁদে।
বিপন্ন হবে সুস্থতাও। কারণ যখন একজন মানুষ ঋণগ্রস্ত হয়, কিস্তি পরিশোধের দায় তার স্নায়ুর ওপরে চাপ ফেলে, তার মনে স্ট্রেস সৃষ্টি হয়। স্ট্রেস যত বাড়ে তত দুর্বল হতে থাকে ইমিউন সিস্টেম। ভঙ্গুর হয়ে পড়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। দেহমনের সুস্থতা নাশের পাশাপাশি জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
আবার ধরুন, আপনার ইএমআই-এ কেনা জিনিসটি কিস্তি শেষ হওয়ার আগেই হারিয়ে বা চুরি গেল। একদিকে পণ্য হারানোর মনোবেদনা, অন্যদিকে কিস্তি পরিশোধের চাপ। কারণ পরবর্তী কিস্তিগুলোও আপনাকে পরিশোধ করতে হবে পণ্যের উপযোগ ছাড়াই!
অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসটি আবার কিনতেও হবে। ফলে খোয়া যাওয়া পণ্যের মূল্যবাবদ কিস্তি পরিশোধ যেমন অব্যহত রাখতে হচ্ছে, তেমনি যোগ হচ্ছে নতুন পণ্য কেনার বাড়তি খরচ। এটার একটা মানসিক তো চাপ আছে!
আমেরিকানদের মাথাপিছু ঋণ সবচেয়ে বেশি। এর কারণ হচ্ছে ঋণ করার প্রবণতা আর পরিণামে কিস্তির দুষ্টচক্রে জড়িয়ে পড়া।
অটো লোন অর্থাৎ গাড়ির লোন, বাড়ির মর্টগেজ, স্টুডেন্ট লোন- উপার্জন থেকে এগুলোর কিস্তি পরিশোধের পর হাতে যা থাকে তা দিয়ে আর নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নগদে কেনার উপায় থাকে না। সেটাও কিনতে হয় বাকিতে। আর এটাই তাদের জাতীয় জীবনে অশান্তির বড় একটি কারণ।
‘ধার করে ঘি খাওয়া’র মানসিকতা মার্কিনদেরই বেশি। ট্র্র্যাঙ্কুইলাইজার বা অস্থিরতানাশক ওষুধ বিক্রিও বেশি হয় ওদেশে।
অর্থাৎ অশান্তি ওখানেই সবচেয়ে বেশি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যার কারণ ঋণের চাপ।
অনেকেই আছেন যারা ক্যাশ ক্রেডিট বা পারসোনাল লোন পছন্দ করেন না। সুদ খাবেন না বলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করা এবং ব্যাংক লেনেদেনেও যেতে চান না। কিন্তু ঠিকই ব্যবহার করেন ক্রেডিট কার্ড!
আবার কেউ কেউ আছেন ভোগ্যপণ্যের ঋণকে ঠিক ঋণ বলে গণ্য করেন না। কিন্তু এগুলোও ঋণ। এবং আর যে কোনো ঋণেরই রয়েছে খারাপ পরিণতি।
হাতের দামী স্মার্টফোনটা কেনার ছয় মাস বা এক বছর না যেতেই বাজারে এলো ‘লেটেস্ট মডেলের’ স্মার্টফোন। ‘পুরনো’ ফোন হাতে নিয়ে ঘুরলে তো ‘স্ট্যাটাস’ থাকে না’- এই চিন্তায় লেটেস্ট মোবাইলটি কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটি শ্রেণীর মানুষ। কাজটা ‘সহজ’ করে দেয় ইএমআই।
নতুন মডেল বাজারে আসার আগেই প্রি-অর্ডারের সুযোগ রাখে কোনো কোনো কোম্পানি। মানুষও কেনে দেদার। তাতে কিস্তির ফাঁদে পড়াটাও হয়ে যায় সহজ।
গত কয়েক দশকে সমাজের একটি শ্রেণির মানসিকতায় বড় পরিবর্তন এসেছে। তারা বাকিতে কিনতে পারাটাকে স্ট্যাটাস সিম্বল ভাবছে। সুপারশপে গিয়ে টাকা গুনে বিল মেটানো কী যে লজ্জার ব্যাপার! ‘আপনি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন না!’- সেলসম্যানের মুখে এ যেন ইজ্জতের সওয়াল!
অথচ বাস্তবতা হচ্ছে ইমআই, ক্রেডিট কার্ড বা ভোগ্যপণ্য ঋণ নিয়ে কেনাটা মোটেই স্ট্যাটাস সিম্বল না। বরং এটা আপনার অক্ষমতারই প্রকাশ!
মনে করুন একজন মানুষ, ঘরে খাবার নেই বলে যিনি খাবার কিনতে কারো কাছে ধার চাইছে- এই মানুষটির সাথে আপনার খুব বেশি ফারাক নেই যদি আপনাকে কিস্তিতে বা কনজ্যুমার লোনের টাকায় কিছু কিনতে হয়।
তাই যা-ই কিনুন, নিজের সামর্থ্য ও প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নগদে কিনুন। আপনি সুস্থ থাকবেন, থাকবেন কিস্তির চাপমুক্ত প্রশান্ত, নির্ভার।