খাবার অপচয়ের ব্যাপারে সচেতন হোন

  • বিশ্বজুড়ে মাথাপিছু খাবারের অপচয় দৈনিক প্রায় ৪৫০ গ্রাম, অথচ অপুষ্টিতে ভুগছে ৮০ কোটি মানুষ!
  • যতটা খাবার প্রতিবছর অপচয় হয় তার অর্ধেকটা দিয়ে আফ্রিকার ১ বছরের খাবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব
  • খাওয়ার জন্যে বাঁচা, নাকি বাঁচার জন্যে খাওয়া- সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি বাঁচাবে খাবারের অপচয়
  • উৎসবের দিনগুলোতে খাবারের অপচয় বেশি হয়- রিপোর্ট FAO’র
  • আপনার অল্প কিছু পদক্ষেপ খাবারের অপচয় বাঁচিয়ে দেবে অনেকখানি।

পৃথিবীতে বাড়ছে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। তবে সম্পদের স্বল্পতা নয়, বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার প্রধান কারণ হচ্ছে খাদ্যের অপচয়- অভিমত আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (IFAD) প্রেসিডেন্ট গিলবার্ট হুংবোর।

খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) রিপোর্ট মোতাবেক, বিশ্বে প্রতি বছর যে পরিমাণ খাবার উৎপাদিত হয় তার এক-তৃতীয়াংশই অপচয় হয়; যার পরিমাণ প্রায় ১৩০ কোটি টন! মাথাপিছু গড়ে প্রতিদিন প্রায় আধা কেজি খাবার আমরা অপচয় করি। অথচ এই একই সময়ে বিশ্বজুড়ে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে ৮০ কোটি মানুষ!

কেন এই অপচয়?

যে খাবারগুলো বেশি নষ্ট হয় তালিকা করলে সবজি ও ফলমূল থাকবে তার শীর্ষে।

ঘরে ফ্রিজ আছে, বেশি বাজার করলে ক্ষতি নেই- এই চিন্তা থেকে বা ঘন ঘন বাজার করার 'ঝামেলা' এড়াতে অনেকে একবারে প্রচুর বাজার করেন। সব সবজি বা ফল সমান মাত্রায় পচনশীল না। ফলে ফ্রিজে রাখার পরও এসব পণ্যের একটি অংশ ফেলে দিতে হয় পচে যাওয়ায় বা মান নষ্ট হওয়ার কারণে।

এ-ছাড়াও কোন পণ্য কতদিন সংরক্ষণ করা যাবে তা বিবেচনা না করে, বা কতটা লাগতে পারে সেটা হিসেব ছাড়াই বাজার করলে নষ্ট হতে পারে এর একাংশ। আবার একবারে প্রচুর খাবার রান্না করে ফ্রিজে রাখলে কিছুদিন পর স্বাদ কমে যাওয়ায় এর একটি অংশের গন্তব্য হয় ডাস্টবিন।

অপচয়ের কারণ যখন 'চোখের ক্ষুধা'

ভরপেট খাওয়ার পরও সামনে লোভনীয় খাবার এলে আমরা অনেক সময়ই আমাদের রসনাকে সংযত রাখতে পারি না, খেতে পারি আর না-ই পারি, পাতে তুলে নিই। এটা হলো 'চোখের ক্ষুধা'! পেটের এবং চোখের ক্ষুধার সংঘাতে আমরা প্রায়শই প্রচুর খাবার অপচয় করে ফেলি।

যেমন- বুফে খাবার। নামীদামী অনেক হোটেল-রেস্তোঁরা প্রায়ই বুফে ভোজের আয়োজন করে। সামনে টেবিলভর্তি লোভনীয় খাবার, খাওয়া যাবে ইচ্ছেমতো। মওকাবুঝে এত বেশি পরিমাণ খাবার অনেকেই নেন যা খেয়ে শেষ করতে পারেন না, উচ্ছিষ্ট হিসেবে ছেড়ে আসেন।

বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানের ভোজেও দেখা যায় একই চিত্র। 'গিফটের মূল্য উশুল' করার অভিপ্রায়ে দফায় দফায় খাবার নিয়ে শেষমেশ অনেকখানি এঁটো করে রেখে আসেন বেশিরভাগ মানুষ।

আরো পড়ুন:-

ডিসকাউন্টের কেরামতি!

অনলাইনে প্রায়শই ভোগ্যপণ্যে বড় বড় ‘ছাড়’ দিতে দেখা যায়। হিউম্যান সাইকোলজি হলো, আমরা ডিসকাউন্ট পেলে কিনি বেশি, অপচয়ও করি বেশি।

ধরুন, বাজারে ১০০ টাকা ডজনের ডিম অনলাইনে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আপনি সচরাচর একসাথে এক ডজন ডিম কেনেন; কিন্তু ডিসকাউন্ট পেয়ে ৪/৫ ডজন কিনে ফেললেন। পরে দেখা যাবে, যে-টাকাটা বাঁচাবেন বলে এতগুলো কিনলেন তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দীর্ঘদিন জমিয়ে রাখায় কিছু ডিম নষ্ট হওয়ার কারণে!

ডিসকাউন্টে এক টিনের জায়গায় দুই/তিন টিন বিস্কুট কেনার পর অনেকদিন ঘরে থেকে নরম হয়ে যাওয়ায় এর অনেকটাই হয়তো আপনাকে ফেলে দিতে হয়েছে বহুবার!

অপচয় রোধ যে কারণে জরুরি

কীভাবে ও কতটা খাবার আপনার অপচয় হচ্ছে- বেশি না, মাত্র এক মাস পর্যবেক্ষণ করুন। দেখবেন অপচয় হওয়া খাবারের মূল্যবাবদ আপনার মাসিক আয়ের একটি অংশ অপব্যয় হয়ে যাচ্ছে। একটু সচেতন হলেই কিন্তু আপনি টাকাটা বাঁচিয়ে অন্য কোনো কাজে লাগাতে বা সঞ্চয় করতে পারেন।

আসলে খাবার হলো স্রষ্টার নিয়ামত। এই মুহূর্তে আপনার সামনে যে খাবার রয়েছে, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ তা থেকে বঞ্চিত। খেতে না পেরে যে খাবার আপনি ফেলে দেন, খাবার না পেয়ে সেটা-ই হয়তো আরেকজন ডাস্টবিন ঘেঁটে খায়।

কাজেই খাবারের জন্যে শুকরিয়ার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও চেষ্টা থাকা উচিত এর একটি কণাও অপচয় হতে না দেয়া। হিসাবমতে, সারাবিশ্বে যতটা খাবার অপচয় হয় তার অর্ধেকটাও যদি বাঁচানো যায় তাহলে তা দিয়ে আফ্রিকার পুরো এক বছরের খাবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব!

আরো পড়ুন:-

তাই সচেতন হোন; আপনার কিছু পদক্ষেপ বহুলাংশে বাঁচিয়ে দেবে খাবারের অপচয়

১. চাই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি

খাওয়ার জন্যে বাঁচবেন, নাকি বাঁচার জন্যে খাবেন- আপনার দ্বারা খাবারের অপচয় হবে কিনা তার অনেকটাই নির্ভর করছে এই দৃষ্টিভঙ্গি দুটির মধ্যে কোনটিকে গ্রহণ করছেন তার উপর।

বাঁচার জন্যে যে খাওয়া তাতে অপচয় হওয়ার সুযোগ নেই। এটাই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, এবং আপনি যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন তাহলে সামনে যত লোভনীয় খাবারই আসুক না কেন, আপনি পাতে ততটুকুই নিতে পারবেন যতটা আপনার ক্ষুধা নিবারণে যথেষ্ট।

২. বাজার করুন ভেবেচিন্তে

সুপারশপে প্রয়োজনীয় জিনিসটি কিনতে গিয়ে এমন অনেক কিছুই আমরা কিনে ফেলি যা অপ্রয়োজনীয়। সমীক্ষায় দেখে গেছে, খাবারের অপচয় বেশি হয় এই ধরণের কেনাকাটায়।

এই প্রবণতা কমাতে বাজারে যাওয়ার আগে কোন পণ্য কতটা প্রয়োজন তা হিসাব করুন, নিশ্চিত হোন স্টকের জিনিসগুলো ফুরিয়েছে কিনা। সবচেয়ে ভালো হয় যদি বাজারের একটি লিস্ট সাথে রাখেন।

৩. খাবার সংরক্ষণ করুন সঠিক পদ্ধতিতে

ফলমূল ও সবজি ভুল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করলে সেগুলো দ্রুত শুঁকিয়ে বা পচে খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়।

ফ্রিজে নয়, আলু টমেটো রসুন শশা পেঁয়াজ রাখুন ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায়। আলু আপেল শাকপাতার মতো ইথিলিন-সেনসিটিভ ফল-সবজি থেকে কলা আভাকাডো টমেটো পিচ নাশপাতি দূরে রাখুন। প্রচুর মৌসুমি ফল একবারে কিনে ডিপ ফ্রিজে রাখার বদলে পরিমাণমতো কিনে দ্রুত খেয়ে ফেলুন।

ফ্রিজে রাখলে কাঁচা খাবার এবং রান্না খাবার রাখুন আলাদা আলাদা কন্টেইনারে। মাছ-মাংস একদিনে যতটা লাগবে সেই পরিমাণ আলাদা আলাদা প্যাকেট বা কন্টেইনারে ডিপে ফ্রিজে রাখলে টাটকা থাকবে, অপচয়ও কম হবে।

একবারে বেশি পরিমাণ পেঁয়াজ রসুন বা আলু কিনলে সেগুলো মুখবন্ধ কিছুতে না রেখে স্বাভাবিক আলো-বাতাস চলাচল করে এমন স্থানে ছড়িয়ে রাখুন।

৪. ফ্রিজে খাবার-দাবার এমনভাবে রাখুন যাতে সব খাবারই চোখের সামনে থাকে

এ-জন্যে ‘ফার্স্ট ইন ফার্স্ট আউট’ (FIFO) পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন। মানে একই ফল বা সবজি যদি আবারো কিনে আনেন তাহলে পুরনোগুলো সামনের দিকে এবং নতুনগুলো পেছনের দিকে রাখুন। তাহলে পুরনোগুলো আগে ব্যবহার করার কথা মনে থাকবে।

৫. মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দেখে কিনুন

খাদ্যদ্রব্য কেনার সময় প্রোডাক্টের এক্সপায়েরি ডেট বা মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দেখে নিন, যেন মেয়াদ থাকতেই খেয়ে শেষ করার জন্যে পর্যাপ্ত সময় হাতে পান। বিশেষত ব্রেড ও অন্যান্য প্যাকেটজাত খাবার, যেগুলোর মেয়াদ বেশিদিন থাকে না, সেগুলো একবারে বেশি কিনবেন না। আর প্যাকেট খোলার পর ফেলে না রেখে দ্রুত খেয়ে ফেলুন।

৬. ফল ও সবজির খোসা ও বীজও খেতে পারেন

ফল বা সবজীর খোসাতেই সর্বাধিক পরিমাণে পুষ্টি উপাদান থাকে। আপনি চাইলে আপেল আলু গাজর শশা আম কিউয়ি বেগুন তরমুজ ও লাউয়ের খোসা রান্না করে খেতে পারেন। কুমড়া লাউ স্কোয়াশ ও কাঁঠালের বীজ শুঁকিয়ে ভেজে খেতে পারেন স্ন্যাকস হিসেবে।

এছাড়াও একটু বেশি পাকা পেঁপে, কলা ইত্যাদি ফেলে না দিয়ে জ্যুস বানিয়ে খেতে পারেন।

৭. উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে দিন বাড়তি মনোযোগ

FAO-এর তথ্য অনুযায়ী বড়দিন, নববর্ষসহ উৎসবের দিনগুলোতে খাবার অপচয়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। আমাদের দেশেও দুই ঈদ এবং বিয়ে, মেজবানসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রচুর খাবার অপচয় হতে দেখা যায়, এমনকি তুলনামূলক অস্বচ্ছল পরিবারগুলোতেও।

সচেতন হোন, লোকদেখানো মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসুন। অতিরিক্ত যা আয়োজন করতেন সেটা বাঁচিয়ে যদি কোনো নিরন্ন-ক্ষুধিতের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারেন তাহলেই পরিপূর্ণ হবে সকল উৎসব-অনুষ্ঠানের আনন্দ।

আরো পড়ুন:-