এক স্বনামধন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষক। গত ১৫ বছর ধরে যুক্ত আছেন শিক্ষকতা পেশার সাথে।
বিগত বছরগুলোতে শিশুদের মানসিক বিকাশ ও আচরণে যে আমুল পরিবর্তন তা খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করেছেন তিনি।
তার ভাষ্যমতে, গত পাঁচ-ছয় বছরে শিশুদের মাঝে যত বেশি ADHD, দুর্বল স্মৃতিশক্তি বা মনোযোগের অভাব দেখা যাচ্ছে, এর আগের এতটা প্রকটভাবে কখনোই যা দেখা যায় নি।
তিনি বলেন, বর্তমানে অভিভাবকরা তাদের শিশুদের যে দুটি বিষয় নিয়ে সবচাইতে বেশি অভিযোগ করেন তা হলো ADHD এবং অতিরিক্ত স্ক্রিন আসক্তি।
শিশুদের স্ক্রিন আসক্তি শিশুদের মানসিক বিকাশে বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে
ADHD (Attention deficit hyperactivity disorder) একটি মানসিক ডিজঅর্ডার।
বর্তমানে বিশ্বে ২ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের ২.৪% অর্থাৎ ৩৮৮,০০০ জন ADHD তে আক্রান্ত!
ADHD তে আক্রান্ত শিশু (ছবিসূত্র : parenting.firstcry.com)
ADHD তে আক্রান্ত শিশুরা স্থির হয়ে এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না। অতিরিক্ত চঞ্চলতা, মনোযোগ বসাতে না পারা, আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা, সহজেই ধৈর্য হারানো, খুব বেশি রাগ জেদ করা, দিকনির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে না পারা, অগোছালো কাজ এবং হঠকারিতা ADHD আক্রান্ত শিশুদের প্রধান লক্ষণ।
অধিকাংশ সময়েই অভিভাবকরা এই আচরণগুলোকে ‘বাচ্চাদের দুষ্টামি’ মনে করে অতিরিক্ত শাসন করেন। তবে এতে হয় হিতে বিপরীত।
Radboud University Nijmegen Medical Centre ২০১৮ সালে তাদের গবেষণায় ADHD সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য তুলে ধরে।
গবেষকরা বলেন, ADHD আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কের আয়তন ও আকার সাধারণ মস্তিষ্কের তুলনায় ছোট হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে ADHD আক্রান্ত শিশু মস্তিষ্কের আয়তন ও আকার সাধারণ মস্তিষ্কের তুলনায় ছোট হয়
সাধারণ মস্তিষ্কের তুলনায় ADHD মস্তিষ্ক বেশ ধীর গতিতে পরিপূর্ণ হয়, যা কখনো এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত পিছিয়ে থাকে। এমনকি কোনো পদক্ষেপ না নিলে ADHD মস্তিষ্ক কখনোই একজন সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের মতো পরিপক্বতা লাভ করতে পারে না।
গবেষণায় আরো জানা যায়, ADHD মস্তিষ্কে অ্যামিগডালা ও হিপ্পোক্যাম্পাস মস্তিষ্কের এই দুটো গুরুত্বপূর্ণ অংশই আকারে ছোট হয়ে থাকে। এই দুটো অংশ মানুষের আবেগিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
একারণেই ADHD আক্রান্ত একজন শিশুর মধ্যে অতিরিক্ত চঞ্চলতা, যে-কোনো কাজে খুব সহজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, ধৈর্যচ্যুতি ইত্যাদি দেখা যায়।
২০২০ সাল থেকে প্রায় দু বছর শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষণ ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে তা এখনো তারা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারে নি।
আর দু দুটো বছর ঘরে থেকে ভার্চুয়াল শিক্ষাপদ্ধতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে অধিকাংশ শিশুই হয়ে পড়েছে স্ক্রিন আসক্ত। এই আসক্তি যে কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তা সহজেই বোঝা যায় আমাদের চেনা পরিমণ্ডলের শিশুদের দেখলেই।
ভার্চুয়াল শিক্ষাপদ্ধতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে অধিকাংশ শিশুই হয়ে পড়েছে স্ক্রিন আসক্ত (ছবিসূত্র : www.newsbharati.com)
বয়স অনুযায়ী দেরিতে কথা বলা, মোবাইল না পেলেই জেদ চিৎকার চেঁচামেচি মারামারি, নতুন পরিমণ্ডলে মিশতে না পারা, কথা বলতে না চাওয়া, নতুন কিছু শিখতে না চাওয়া এমন আরো অসংখ্য সীমাবদ্ধতা নিয়ে শিশুরা বেড়ে উঠছে যা একজন শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
আপাতদৃষ্টিতে বিষয়গুলো খুব স্বাভাবিক মনে হলেও এর পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।
কারণ একেবারে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয়া একজন শিশুও পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের অভাবে অটিজমের মতো জটিল মানসিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হতে পারে।
বর্তমান ছুটে চলা এই বিশ্বে অধিকাংশ পরিবারেই বাবা-মা দুজনেই কর্মরত।
ফলে সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেয়ার সময় বা সুযোগ পাচ্ছেন না অনেকেই। যেটুকু সময়ও বা পাচ্ছেন, বাবা-মা সন্তানের হাতে এই ভেবে ডিভাইজ তুলে দিচ্ছেন যে এই যন্ত্রই তার সন্তানকে স্মার্ট ও যুগোপযোগী করে তুলবে!
অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের পর থেকে প্রথম তিন বছর একজন শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে বাবা-মা ও অভিভাবকের কাছ থেকে পরিপূর্ণ মনোযোগ ও মমতা, সন্তানের উদ্দেশ্যে সবসময় ইতিবাচক কথা বলা, প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া, নিজের ছোট ছোট কাজগুলো নিজেকেই করতে শেখানো, বই পড়ে শোনানো, ছবি আঁকা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে বড় ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে তাকে সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত রাখুন (ছবিসূত্র : www.prothomalo.com)
আর একেবারে টনিকের মতো যেই জিনিসটি আপনার সন্তানের পরিপূর্ণ বিকাশে সাহায্য করবে তা হলো মেডিটেশন!
সভ্যতার একেবারে শুরু থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের মতো এত প্রতিযোগিতামূলক সময় এর আগে কোনো প্রজন্মের শিশুই পার করে নি। সবসময় একটা ছুট ছুট দৌড় দৌড় ভাব!
এই ছোটাছুটি আপনার অজান্তেই আপনার শিশুর মধ্যে তৈরি করছে স্ট্রেস।
স্বাভাবিকভাবেই একজন শিশুর এই স্ট্রেস সামলাবার মতো সক্ষমতা তৈরি হয় না। আবার স্ট্রেসের বহিঃপ্রকাশও সে দেখাতে পারে না।
ফলে এই স্ট্রেস ধীরে ধীরে তার মানসিক, শারীরিক, সামাজিক, আত্মিক বিকাশের পথে বাধা তৈরি করে।
এর প্রকাশ ঘটে ছোট ছোট ব্যাপারে টেনশন করা, অস্থিরতা, মনোযোগহীনতা, সহজেই ভুলে যাওয়া, বিষণ্ণতা, খেলাধুলায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, খাবারে অনীহা- এসবের মাধ্যমে।
তাই আপনার সন্তানের যেকোনো মানসিক অস্থিরতাকে মোকাবেলা করতে ছোটবেলা থেকেই তাকে মেডিটেশনে অভ্যস্ত করে তুলুন।
ছোটবেলা থেকেই তাকে মেডিটেশনে অভ্যস্ত করে তুলুন (ছবিসূত্র : www.morainevalley.edu)
মেডিটেশন মস্তিষ্কের সেই অংশগুলোকে সক্রিয় করে তোলে যা স্মৃতি ধরে রাখা, মনোযোগ, ধৈর্যশক্তি বৃদ্ধি, শেখার আগ্রহ বৃদ্ধিতে সহায়ক।
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত যে শিশুরা মেডিটেশন চর্চা করে, তাদের সামাজিক আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়।
সমবয়সীদের প্রতি সমমর্মিতা, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রাগ ক্ষোভ জেদ সামলানোর দক্ষতা, ক্লাসে মনোযোগ বৃদ্ধি, ডিপ্রেশন স্ট্রেস দূর, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি এমনকি ADHD কেও দারুণভাবে মোকাবেলা করার অনবদ্য এক হাতিয়ার হিসেবে মেডিটেশনকে স্বীকৃতি দিয়েছেন গবেষকরা।
শিশুরা তার পরিচিত পরিমণ্ডলে যা দেখে তাই খুব সহজে রপ্ত করে ফেলে।
তাদের এই সহজাত প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই শিশুকে মেডিটেশন শেখানো যায়।
এরজন্যে মেডিটেশনকে একটি পারিবারিক চর্চায় রূপ দিন।
প্রতিদিন সকালে এবং রাতে ঘুমুতে যাবার আগে পরিবারের সবাই মিলে একসাথে মেডিটেশন করুন। সাথে অবশ্যই পরিবারের খুদে সদস্যটিকেও নিন।
পরিবারের ছোট বড় সবাই একসাথে মেডিটেশনে অংশ নিন
শুরুতেই শিশুদের জন্যে দীর্ঘসময়ে মেডিটেশন করা কঠিন ব্যাপার। তাই ৫-১০ মিনিটই শিশুর জন্যে যথেষ্ট।
তাকে দমের দিকে মনোযোগ দিতে বলুন। ধীরে ধীরে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের দিকে নজর দিতে বলুন। বার বার ইতিবাচক কথা বলতে থাকুন।
এছাড়াও সন্তানকে ডিভাইসমুক্ত রেখে নিজে সময় দিন।
নিয়মিত এই চর্চার ফলে আপনার সন্তানের মনোযোগ বৃদ্ধি ও মনের অস্থিরতা দূর হবে।
সে হয়ে উঠবে আরো চৌকশ, বুদ্ধিমান, প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী এবং যথার্থ স্মার্ট!
তাই আর দেরি না করে আপনার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে আজ থেকেই মেডিটেশন চর্চা শুরু করুন!
রেফারেন্স :