তথ্যের ভিড়ে সুস্থ মন: 'ইনফরমেশন ডায়েট' আপনার নতুন প্রয়োজন

published : ২০ নভেম্বর ২০২৫

ডিজিটাল এই যুগে আমরা প্রতিনিয়ত তথ্যের সমুদ্রে সাঁতার কাটছি যেন। ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আমরা অবিরাম তথ্য গ্রহণ করে চলেছি টিভি, পত্রপত্রিকা, সোশাল মিডিয়ার মারফৎ। কিন্তু এই তথ্যের অতিরিক্ত প্রবাহ কি আমাদের মন ও শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে? 

অর্ণার গল্প: তথ্য যখন হয়ে দাঁড়ায় বোঝা

অর্ণা, একজন তরুণ ফ্রিল্যান্সার। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজ করতে গিয়ে তাকে সারাদিন ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুবে থাকতে হয়। কাজের বাইরেও সে বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল, অনলাইন ফোরাম আর ইউটিউব চ্যানেলে সময় কাটাত। প্রথমদিকে ভাবত খুব আপডেটেড থাকতে পারছে। কিন্তু ধীরে ধীরে অর্ণা অনুভব করতে শুরু করল এক অদ্ভুত অস্থিরতা। ঘুমের সমস্যা, মনোযোগের অভাব, আর সারাক্ষণ একটা চাপা উদ্বেগ তাকে ঘিরে রাখে যেন।  

"মনে হতো, যেন আমার মস্তিষ্কটা সারাক্ষণ ওভারলোডেড," বলছিল অর্ণা। "সবকিছু জানতে চাওয়ার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাকে ক্লান্ত করে দিত।" 

একসময় সে সিদ্ধান্ত নিল, তাকে তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। 

মনোদৈহিক স্বাস্থ্যের ওপর অতিরিক্ত তথ্য গ্রহণের প্রভাব

অতিরিক্ত তথ্য গ্রহণ বা 'ইনফরমেশন ওভারলোড' এখন এক বৈশ্বিক সমস্যা। আমাদের মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট পরিমাণ তথ্য প্রক্রিয়া করতে পারে। যখন এই সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন তা মনোদৈহিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিপ্রভাব ফেলে, যার মধ্যে আছে- 

মানসিক চাপ ও উদ্বেগ: খারাপ খবর বা নেতিবাচক তথ্যের অবিরাম প্রবাহ আমাদের মনে ভয় ও উদ্বেগের এমনকি ডিপ্রেশনের জন্ম দিতে পারে।

মনোযোগের অভাব: অসংখ্য ট্যাব খোলা রাখা বা বারবার নোটিফিকেশন চেক করার অভ্যাস আমাদের মনোযোগকে বিভক্ত করে দেয়, যা কমিয়ে দেয় কাজের গুণগত মান।

ঘুমের সমস্যা: ঘুমানোর আগে স্ক্রিন টাইম মস্তিষ্কের মেলাটোনিন হরমোনের উৎপাদন ব্যাহত করে, যা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।

শারীরিক ক্লান্তি: মানসিক ক্লান্তির কারণে শারীরিক ক্লান্তিও আসে, যা কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের মস্তিষ্ক সব তথ্য সমানভাবে প্রক্রিয়া করতে পারে না। অপ্রয়োজনীয় তথ্যের ভিড়ে প্রয়োজনীয় তথ্য চাপা পড়ে যায়, যার ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণেও সমস্যা হয়।

ইনফরমেশন ডায়েট: সুস্থ থাকার নতুন কৌশল

ইনফরমেশন ডায়েট মানে এই নয় যে, আপনি তথ্য গ্রহণ একেবারেই বন্ধ করে দেবেন। বরং, এটি হলো সচেতনভাবে কোন তথ্য গ্রহণ করবেন এবং কোন তথ্য বর্জন করবেন, তা নির্ধারণ করা। ঠিক যেমন আমরা শরীরের সুস্থতার জন্য খাবারের ডায়েট করি, তেমনি মনের সুস্থতার জন্য তথ্যের ডায়েট করা প্রয়োজন।

ইনফরমেশন ডায়েট কীভাবে কাজ করে?

১. সচেতন বাছাই: আপনি ঠিক কোন ধরনের তথ্য চান, তা আগে থেকে ঠিক করে নিন। সব খবর বা সব সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট আপনার জন্যে জরুরি নয়।

২. সীমা নির্ধারণ: প্রতিদিন বা সপ্তাহে কতক্ষণ আপনি ডিজিটাল মাধ্যমে থাকবেন, তার একটি নির্দিষ্ট সীমা সেট করুন। যেমন– দিনে সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার বা নির্দিষ্ট সময় পর পর ইমেল চেক করা।

৩. মানসিক স্পেস তৈরি: অপ্রয়োজনীয় তথ্য মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে দিলে মানসিক স্পেস তৈরি হয়। এই স্পেস সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধান এবং গভীর চিন্তাভাবনার জন্য সহায়ক।

৪. ইতিবাচক তথ্যের গুরুত্ব: নেতিবাচক তথ্যের পরিবর্তে অনুপ্রেরণামূলক, শিক্ষামূলক বা ইতিবাচক বিষয়বস্তু গ্রহণে জোর দিন।

৫. নিয়মিত 'ডিজিটাল ডিটক্স': মানে সপ্তাহে অন্তত একদিন বা দিনের কিছু নির্দিষ্ট সময় সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল মাধ্যম থেকে দূরে থাকুন। ফোন বন্ধ রাখুন, ল্যাপটপ বা টিভি দেখাও বাদ থাকবে।

মনোবিজ্ঞানী ড. কেল নিউপোর্ট, তার 'Digital Minimalism' বইতে বলেন, "ডিজিটাল সরঞ্জামগুলোকে আপনার জীবনের উদ্দেশ্য পূরণের সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করুন, সেগুলোর কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না।" অর্থাৎ, প্রযুক্তি যেন আপনাকে নিয়ন্ত্রণ না করে, বরং আপনিই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করুন।

কীভাবে শুরু করবেন

নোটিফিকেশন বন্ধ করুন: ফোনের অপ্রয়োজনীয় অ্যাপের নোটিফিকেশন বন্ধ রাখুন, যাতে বারবার আপনার মনোযোগ বিঘ্নিত না হয়।

নির্দিষ্ট সময় রাখুন: ইমেল ও সোশ্যাল মিডিয়া চেক করার জন্য দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময় বরাদ্দ করুন।

ঘুমের আগে স্ক্রিন ত্যাগ: ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে সব ধরনের ডিজিটাল স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুন। বই পড়ুন বা হালকা মেজাজের গান শুনতে পারেন।

'আনফলো' বা 'মিউট' করুন: যেসব অ্যাকাউন্ট বা পেজ আপনাকে নেতিবাচক অনুভূতি দেয়, সেগুলোকে আনফলো বা মিউট করুন।

অফলাইন কার্যক্রমে সময় দিন: বই পড়া, বাগান করা, বন্ধুদের সাথে সরাসরি আড্ডা বা শারীরিক ব্যায়ামের মতো অফলাইন কার্যক্রমে মনোযোগ দিন।

ইনফরমেশন ডায়েট হোক সুস্থতার পথে আপনার নতুন পদক্ষেপ

ইনফরমেশন ডায়েট শুধুমাত্র তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ নয়, এটি আমাদের মনোদৈহিক সুস্থতার প্রতি সচেতন থাকার এক আধুনিক উপায়। অর্ণার মতো অনেকেই এই নতুন অভ্যাসের মাধ্যমে মানসিক শান্তি ফিরে পেয়েছে। বাংলাদেশেও যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে, সেখানে এই 'তথ্য সচেতনতা' অত্যন্ত জরুরি।

আজ থেকেই নিজের জন্যে এই ছোট বিনিয়োগ শুরু করে দেখুন না! হয়ত এই ছোট অভ্যাসটিই আপনার জীবনকে আরও শান্ত, সৃজনশীল এবং অর্থপূর্ণ করে তুলবে।