published : ৯ ডিসেম্বর ২০২৪
বুলিংকে বলতে পারেন আধুনিক সময়ের সামাজিক ব্যাধি। এর শিকার হতে পারে যে-কেউই। তবে স্কুলগামী শিশুকিশোরদের বুলিংয়ের শিকার হতে দেখা যায় বেশি।
২০২১ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে ৪৪ শতাংশই বুলিংয়ের শিকার।
অর্থাৎ, ২০ বছর আগে বুলিংকে নেহায়েত ছেলেমানুষি হিসেবে ধরে নিলেও বর্তমানে একে গুরুত্বহীন মনে করার কোনো কারণ নেই!
চড় লাথি ধাক্কার মতো শারীরিক আঘাত বুলিং। আবার শারীরিকভাবে কিছু না করেও একজন মানুষকে পর্যুদস্ত করা যায় মানসিকভাবে।
গালিগালাজ, অশালীন অঙ্গভঙ্গি বা রসিকতা করে বিব্রত করা, আপত্তিকর নামে ডাকা, বডি শেমিং, বর্ণবাদী মন্তব্য করা, গুজব ছড়ানো- এসব বুলিং হতে পারে মানসিক আঘাতের কারণ।
ক্রমাগত এমন অবমাননাকর আচরণ পেতে থাকলে ব্যহত হতে পারে শিশুকিশোরদের শারীরিক-মানসিক বিকাশ।
ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যম, যেমন সোশ্যাল মিডিয়া, মেসেজিং অ্যাপস বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কাউকে উত্যক্ত করা, ভয়ভীতি দেখানোর নামই সাইবার বুলিং।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও বা মেসেজের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে দেয়া, ছবি-ভিডিও এডিট করে ফেইক কন্টেন্ট প্রকাশ, কারো নামে নেতিবাচক, ক্ষতিকর বা মিথ্যা কনটেন্ট প্রকাশ, আপত্তিকর মেসেজ পাঠানো যার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বিব্রত বা অপমানিত হয়- এর সবই সাইবার বুলিংয়ের অন্তর্ভুক্ত।
২০১৯ সালে ইউনিসেফের এক রিপোর্টে উঠে আসে ভয়াবহ তথ্য। বাংলাদেশে সাইবার বুলিং বা ডিজিটাল হ্যারাসমেন্টের শিকার ৩২ শতাংশের বয়স ১০ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে!
মস্তিষ্কের নিউরোন সেলগুলোকে আবৃত করে রাখে মায়েলিন নামক এক ধরনের ফ্যাটি পদার্থ। একটা থেকে আরেকটা নিউরোন সেলে যেন দ্রুত কার্যকর উপায়ে তথ্য সরবরাহ হতে পারে তা নিশ্চিত করাই মায়েলিনের কাজ। অর্থাৎ, নতুন নতুন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা, সৃজনশীলতার বিকাশ, দক্ষতা অর্জনে মায়েলিনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
‘সাইকোলজি টুডে’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে জানা যায়, অপরিণত বয়সে বুলিংয়ের শিকার হলে অতিরিক্ত ‘টক্সিক স্ট্রেস’এর কারণে মায়েলিনের কর্মক্ষমতা কমে যায়। ফলে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ হয় বাধাগ্রস্ত।
বিজ্ঞানীদের মতে, একজন সুস্থ মানুষের মস্তিষ্ক আমৃত্যু নতুন নতুন নিউরোন সেল গঠনে সক্ষম। ব্রেইন ইমেজিংএ দেখা গেছে, কাউকে যখন ক্রমাগত বুলিং করা হয় তখন নতুন নিউরোন গঠনের এই প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত, এমনকি থেমে যেতে পারে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় নতুন নিউরোন তো জন্ম নিচ্ছেই না, উল্টো বিপুল সংখ্যক পুরনো নিউরোনের মৃত্যু ঘটছে!
বুলিং সবার জন্যে ক্ষতিকর। তবে টিনেজাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। কেননা এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মন থাকে অতিরিক্ত সংবেদনশীল, ব্রেইন থাকে বিকাশমান অবস্থায়। তাই নেতিবাচক আবেগে তাদের সাড়া দেবার প্রবণতাও থাকে বেশি।
বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ এর We're starting to understand what being bullied does to the brain শিরোনামে এক নিবন্ধে বলা হয়, বুলিংয়ের কারণে টিনএজ ব্রেনের ৪৯টি জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়! ফলে ভুক্তভোগীদের মাঝে দেখা যায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, হীনম্মন্যতা, ক্রনিক ডিপ্রেশন, পড়াশোনায় অমনোযোগ, Post-traumatic stress disorder (PTSD), এমনকি আত্মহত্যা-প্রবণতা।
এছাড়াও, বুলিংয়ে আক্রান্ত শিশুকিশোরেরা সামাজিকভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে, নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে করে এবং নিজের যোগ্যতা-দক্ষতার ওপর থেকে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় স্কুল বুলিংয়ের দেশ। ১৯৯৯ সালের ২০ এপ্রিল দেশটির কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের কলম্বাইন হাইস্কুলে ঘটা একটি ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে গেছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্ব।
স্কুলের দুই ছাত্র হ্যারিস আর ডিলান ক্লিবোর্ড। স্কুল শুরুর কিছুক্ষণ পর অস্ত্রসহ ঢুকে পড়ে ক্লাসরুমে, নির্বিচারে গুলি চালায় শিক্ষার্থী আর শিক্ষকদের ওপর। ঘটনাস্থলেই মারা যায় ১২ শিক্ষার্থী আর ১ শিক্ষক। হত্যাযজ্ঞ শেষে তারা নিজেরাও আত্মহত্যা করে।
জানা যায় সহপাঠীদের দ্বারা তারা প্রায়ই বুলিংয়ের শিকার হতো। দিনের পর দিন মনে ক্ষোভ জমতে জমতেই ঘটেছিল ক্ষোভের বিস্ফোরণ।
১৯৯৯-এ শেষ হয়ে যেতে পারত যে ঘটনা, শেষ হওয়ার বদলে এখনো মাঝেমধ্যেই সংবাদ হয় যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে বন্দুকধারীর ঢুকে পড়া আর নির্বিচার গুলিতে অজস্র প্রাণহানীর ঘটনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আততায়ী জীবনের শুরুতেই আক্রান্ত হয়েছিল বুলিংএ।
কিছু আচরণগত পরিবর্তন দেখলে বুঝবেন আপনার ছেলে বা মেয়ে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। যেমনঃ
১. শিশুকিশোররা যেখানে বুলিংয়ের শিকার হয় সেটা এড়িয়ে চলতে চায়। আপনার সন্তান কি ইদানিং স্কুলে যেতে চাইছে না? সম্ভবত সে ক্লাসে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে।
২. আগে হাসিখুশি প্রাণবন্ত ছিল, কিন্তু এখন চুপচাপ বিষণ্ণ বা অন্যমনস্ক হয়ে গেছে।
৩. সামাজিক অনুষ্ঠানে যেত। বাসায় মেহমান আসলে কথা বলত, দেখা করত। এখন সামনে আসতে চায় না।
৪. খাওয়াদাওয়া অনেক কমে গেছে বা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
৫. আত্ম-ধ্বংসাত্মক আচরণ, যেমন বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া, নিজের ক্ষতি করা বা জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে যাওয়া।
১. সহপাঠী বা বন্ধুদের স্বাভাবিক খুনসুটি ভেবে বিষয়টিকে উড়িয়ে দেবেন না, তা যত হাল্কাই লাগুক না কেন। তার সাথে মন খুলে কথা বলুন। তাকে এই উপলব্ধির সুযোগ দিন যে আপনি তার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। দেখবেন সে আস্তে আস্তে মুখ খুলতে শুরু করেছে।
২. বুলিংয়ের কারণে শিশুকিশোরদের আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাকে সাহস ও আত্মবিশ্বাস দিন। বোঝান যে যারা বাজে কথা বলেছে, তারা আসলে মানুষকে খুঁচিয়ে আনন্দ পায়। এটা তাদের রোগ। তারা বলেছে বলেই তোমার এই দুর্বলতা বা ঘাটরি রয়েছে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
৩. অবস্থা তেমন মনে করলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করুন।
৪. বর্তমানে শিশুকিশোররা যে আবেগিকভাবে অত্যন্ত ভঙ্গুর তার অন্যতম দায় বাবা-মা হিসেবে আমাদের। কারণ তাদের আবেগিকভাবে শক্ত হওয়ার সুযোগ আমরা দেই না। তারা বেড়ে উঠছে ননীর পুতুল হয়ে। ফলে বাইরে একটু অস্বাভাবিক কিছু ঘটলেই অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে। শিশুকে অবশ্যই আদর দেবেন। সেই সাথে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সহনশীলও করতে হবে।
৫. মানসিক সহনশীলতা ও খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতা বাড়ানোর একটি চমৎকার মাধ্যম হলো যোগধ্যান। তাই সন্তানকে নিয়মিত মেডিটেশন, যোগব্যায়াম ও সুস্থ জীবনাচারে অভ্যস্ত করুন।