published : ২২ মে ২০২৫
কোয়ান্টাম মেথড হলো সুস্থতা, সাফল্য ও সুখের ২৮টি সূত্রে গাঁথা একটি টুলবক্স, কম্প্যাক্ট সুইস নাইফের মতোই যা জীবনকে সুন্দর করার জন্যে যে-কোনো সময়, যে-কোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করা যেতে পারে। মেডিটেশনের এত বহুমুখী ব্যবহারের কথা কোয়ান্টাম বলছে প্রায় ৩ দশক ধরে।
২৯ নভেম্বর ২০২৪ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সর্বসম্মতিক্রমে ২১ ডিসেম্বরকে ঘোষণা করা হয় বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। শারীরিক মানসিক ও আবেগিকভাবে ভালো থাকার জন্যে মেডিটেশন চর্চার গুরুত্বেরই এ এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
এই ঘোষণার আগেই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ২০২৫ সালকে ঘোষণা করে ‘দ্য ইয়ার অব মেডিটেশন’। এরই প্রেক্ষিতে এই সিরিজ আর্টিকেল, যা মূলত কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের আলোচনাগুলোর অ্যাডাপ্টেশন।
…………………………………………………………………………………………….
সভ্যতার সবকিছুই এই মস্তিষ্কের অবদান। মস্তিষ্কই মানুষকে শিখিয়েছে আগুন ধরাতে, সুপার কম্পিউটার তৈরি করতে, মহাকাশ পাড়ি দিতে। দেড় কেজির এই বিস্ময়কর ক্ষমতার আকরকে ঘাড়ের উপর বয়ে বেড়ানোর পরও আমরা অধিকাংশ মানুষই এই যথাযথ ব্যবহার করতে কেন পারি না? কারণ একে কাজে লাগানোর সঠিক প্রক্রিয়া আমরা বুঝতে পারি না, বা বুঝলেও প্রয়োগ করি না।
কিন্তু সূত্রটা সহজ- মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করার জন্যে প্রয়োজন সুসংহত মানসিক প্রস্তুতি। আর মানসিক প্রস্তুতির ভিত্তি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি, নিয়ত বা অভিপ্রায়। কারণ মন পরিচালিত হয় দৃষ্টিভঙ্গি বা নিয়ত দ্বারা।
ড. অ্যালেন গোল্ডস্টেইন, ড. জন মটিল, ড. ওয়াইল্ডার পেনফিল্ড ও ড. ই রয় জন দীর্ঘ গবেষণার পর বলেছেন, একজন প্রোগ্রামার যেভাবে কম্পিউটারকে পরিচালিত করে, তেমনি মন পরিচালিত করে মস্তিষ্ককে। মস্তিষ্ক হচ্ছে হার্ডওয়্যার আর মন হচ্ছে সফটওয়্যার।
নতুন তথ্য ও নতুন বিশ্বাস মস্তিষ্কের নিউরোনে নতুন ডেনড্রাইট সৃষ্টি করে। নতুন সিন্যাপসের মাধ্যমে তৈরি হয় সংযোগের নতুন রাস্তা। ফলে বদলে যায় মস্তিষ্কের কর্মপ্রবাহের প্যাটার্ন। মস্তিষ্ক তখন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নতুন বাস্তবতা উপহার দেয়।
নতুন বাস্তবতা ভালো হবে না খারাপ হবে, কল্যাণকর হবে না ক্ষতিকর হবে তা নির্ভর করে মস্তিষ্কে দেয়া তথ্য বা প্রোগ্রামের ভালো-মন্দের ওপর। কল্যাণকর তথ্য ও বিশ্বাস কল্যাণকর বাস্তবতা সৃষ্টি করে আর ক্ষতিকর তথ্য বা বিশ্বাস উপহার দেয় ক্ষতিকর বাস্তবতা। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, জীবনের নতুন বাস্তবতার চাবিকাঠি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি বা নিয়ত।
প্রো-অ্যাকটিভ অর্থ হচ্ছে যে-কোনো পরিস্থিতিতে উত্তেজিত বা আবেগপ্রবণ না হয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ। অর্থাৎ অন্যের কাজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে কোনো কাজ বা আচরণ না করা। সর্বাবস্থায় নিজের লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আচরণ ও কর্মপন্থা অবলম্বন করা। কী নেই তা নিয়ে হা-হুতাশ না করে যা আছে তা নিয়েই সুপরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করা। প্রো-অ্যাকটিভ দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় সাফল্য ও বিজয় ছিনিয়ে আনে।
অপরদিকে রি-অ্যাকটিভ দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় ব্যর্থতা, হতাশা ও অশান্তি সৃষ্টি করে। আপনি রি-অ্যাকটিভ হলে আপনার নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে থাকে না, নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অন্যের হাতে। আপনি তখন অন্যের কথায় কষ্ট পান, রেগে যান, ক্রোধে ফেটে পড়েন। অন্যের তোষামোদিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, অন্যের চাটুকারিতায় গলে যান।
বাবা ও ছেলে বাড়ির পোষা গাধাটিকে বিক্রি করার জন্যে হাটের পথে যাত্রা শুরু করল। বাবা, ছেলে ও গাধা তিনজনই হেঁটে যাচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর তাদেরকে দেখে একজন বলল, "লোক দুটি কী বোকা! গাধা থাকতে হেঁটে যাচ্ছে। একজন তো গাধার পিঠে উঠে আরাম করে যেতে পারে!” এ-কথা শুনে বাবা ছেলেকে গাধার পিঠে উঠিয়ে দিলেন।
কিছুদূর যাওয়ার পর আরেকজন বলল, “কী বেয়াদব ছেলে! নিজে গাধার পিঠে আরাম করে যাচ্ছে আর বুড়ো বাপকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে!” এটা শোনার পর বাবা উঠল গাধার পিঠে আর ছেলে গেল হেঁটে।
আরো কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর আরেক ব্যক্তি মন্তব্য করল, “কী নিষ্ঠুর পিতা! নিজে গাধার পিঠে আরাম করছে আর মাসুম বাচ্চাটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে!” এ মন্তব্য শোনার পর বাবা ও ছেলে দুজনই গাধার পিঠে উঠল।
কিছুদূর অগ্রসর হতেই তারা পড়ল এক পশু প্রেমিকের নজরে। পশু প্রেমিক আফসোস করে বলতে লাগল, “কী অমানবিক! একটি গাধা, তার ওপর দুটি লোক!”
বাবা ও ছেলে পড়ল মহা সমস্যায়। গাধার সাথে হেঁটে গেলে দোষ। ছেলে উঠলে দোষ। বাবা উঠলে দোষ। দুজন উঠলেও দোষ। এখন কী করা যায়?
তাদের অসহায়ত্ব দেখে এক ‘বিশেষজ্ঞ’ বাৎলাল করণীয়। সেই মোতাবেক গাধার চার পা ভালো করে বেঁধে পায়ের ফাঁক দিয়ে বাঁশ ঢুকিয়ে দিলো তারা। তারপর বাবা-ছেলে বাঁশটা কাঁধে চাপিয়ে হাঁটতে শুরু করল। গাধা রইল ঝুলে।
কিছুদূর যেতেই একটা খাল। পুল দিয়ে খালটা পার হওয়ার সময় গাধা পানিতে নিজের ছবি দেখে ভয় পেয়ে সর্বশক্তিকে দিলো গা-ঝাড়া। বাবা, ছেলে ও গাধা পড়ে গেল খালে। গাধার মেরুদণ্ড ভাঙল। বাবা ও ছেলের ভাঙল পা। গাধা আর বেচা হলো না। বাবা ও ছেলে খোঁড়া হয়ে ফিরে এল ঘরে।
এটা ছিল দু’জনের রি-একটিভ হওয়ার পরিণতি।
আপনি যখন নিজস্ব বিচার-বিবেচনার পরিবর্তে অন্যের প্ররোচনায় বা অন্যের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে উত্তেজিত হয়ে পদক্ষেপ নেন, তখন তা 'ক্রিয়া' নয়, তখন তা 'প্রতিক্রিয়া'। আর প্রতিক্রিয়া কখনো ক্রিয়ার মতো ফলপ্রসূ হয় না। প্রতিক্রিয়া সবসময় ব্যর্থতা ডেকে আনে।
তাই মস্তিষ্ক নামের জৈব সুপার কম্পিউটারকে কাজে লাগানোর প্রথম ধাপ হচ্ছে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করা। অন্যের কথা বা আচরণ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজ বিশ্বাসে অটল থেকে নিজের কাজটা সবচেয়ে ভালোভাবে করে যাওয়া। তাহলেই মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে আপনি কাজে লাগাতে পারবেন এবং জীবন থেকে আপনি যা যা পেতে চান, তাই পাবেন।
[আর্টিকেলটি কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের ‘দৃষ্টিভঙ্গি : নেপথ্যনায়ক’ অধ্যায় থেকে অ্যাডাপ্টেড। পুরো চ্যাপ্টারটি পড়তে বইটি সংগ্রহ করুন অথবা ই-বুক পড়ুন এই লিংকে]