প্রতিদিন কেন অন্তত আধঘণ্টা হলেও আপনার সূর্যালোকে থাকা উচিত?

১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই সরাসরি সূর্যালোকের সংস্পর্শে থাকত। তারা বাইরে কাজ করত। তাদের ঘরবাড়িগুলোও ছিল এমন যাতে প্রচুর দিনের আলো ঢুকত।

কিন্তু একবিংশ শতাব্দিতে এসে এটা অনেকটাই উল্টে গেছে।

আমেরিকার একটি গবেষণা রিপোর্ট হলো- সেখানে মাছ ধরা বা কৃষিকাজের মতো বাইরের কাজ করে মোট চাকরির মাত্র ১ শতাংশ মানুষ!

ঘনবসতিপূর্ণ শহরের বেশিরভাগ মানুষই এখন এমনসব বাড়িতে থাকে যেখানে সূর্যের আলো ঢোকার জো নেই।

আবার বাসা থেকে অফিসে যখন সে যায়, সাধারণভাবে সেটাও আরেকটা দালান। সূর্যের আলোর অভাব সেখানে পূরণ করা হয় সারি সারি লাইট ব্যবহার করে।

কিন্তু আসলে কি তা সূর্যের আলোর অভাব পূরণ করতে পারে? বা সূর্যের আলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ আমাদের সুস্থতার জন্যে?

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অফিস বা বাসায় যত আলোই থাকুক না কেন তা কখনোই দিনের আলোর সমকক্ষ নয়। কৃত্রিম আলোর চেয়ে দিনের স্বাভাবিক আলো ২৫০ গুণ প্রখর!

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, দীর্ঘসময় সূর্যালোক থেকে বঞ্চিত থাকার প্রভাব পড়তে পারে ঘুমসহ আমাদের সার্বিক ভালো থাকার ওপরই।

আমাদের দেহছন্দ বা সারকাডিয়ান রিদমের সাথে সূর্যালোকের একটা বড় সম্পর্ক আছে।

নির্ধারণ করে কখন আমরা ঘুমোতে যাব বা কখন জেগে উঠব।

যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসে তখন আমাদের শরীর থেকে মেলাটোনিন নিঃসৃত হয়। আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।

আবার আমাদের শরীর যখন দিনের আলো ফুটেছে বলে টের পায়, অপটিক নার্ভ দিয়ে সেই আলোর সংকেত পৌঁছায় মস্তিষ্কে, নিঃসৃত হয় সেরোটোনিন নামের একটি রাসায়নিক।

সেরোটনিন আমাদের মধ্যে আনন্দানুভূতি তৈরি করে। মন-মেজাজ ফুরফুরে রাখে। ফলে জেগে ওঠার বা জেগে থাকার একটা সক্রিয়তা অনুভব করি আমরা।

যে কারণে রাত জাগার পর যারা সকালের আলোর সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের হয়তো কখনো কখনো এমন হয়েছে যে, বিছানায় গেলেও তাদের চট করে ঘুম আসে নি।

কারণ তাদের শরীর এই সংকেত পেয়েছে যে এখন জাগার সময় হয়েছে।  

আলো আর সক্রিয়তার মধ্যে এ সম্পর্কের কারণেই অনেক এয়ারলাইন্সকে দেখা যায় উড়োজাহাজের কেবিনে নানা ধরনের লাইটিং ব্যবহার করতে।

বোর্ডিংয়ের জন্যে তারা ব্যবহার করে উজ্জ্বল আলো। ডিনারের সময় হালকা আলো। আবার সূর্যাস্তের বিভ্রম তৈরির জন্যে ব্যবহার করা হয় বিশেষ আলো, যাতে করে যাত্রীরা ঘুমিয়ে পড়েন।

আপনিও তাই ঘুমোতে যাওয়ার আগে যতটা কম পারা যায় আলোর সংস্পর্শে আসুন। আর সকালের আলোতে বেশি থাকার চেষ্টা করুন।

এতে ভালো ঘুম হবে এবং একই সময়ে ঘুমোতে পারবেন।

একটি ডাচ গবেষণা হয় নার্সিংহোমের কিছু বাসিন্দাকে নিয়ে।

নার্সিং হোমের বেডরুমগুলো অন্ধকার রেখে বাকি জায়গায় পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়।

দেখা যায়, এতে করে বাসিন্দাদের দিনের বেলা ঝিমোনোর সময় কমেছে, বেড়েছে রাতের বেলা ঘুমোনোর সময়। তাদের মানসিক সামর্থ্য ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হয়েছে।

এজন্যেই বলা হয় যাদের রাতে ঘুমোতে বেগ পেতে হয়, তাদের জন্যে সকালের একঘন্টার সূর্যালোক ম্যাজিকের মতো কাজ করতে পারে।

এটি আমাদের বডি ক্লক বা দেহঘড়িকে সঠিক ছন্দে নিয়ে আসে এবং বিছানায় যাওয়ার পর ঘুমকাতুরে করে তোলে।

দিনের আলো থেকে বঞ্চিত থাকার সাথে বিষণ্নতার সম্পর্ক

সূর্যের আলোর সঙ্গে আছে মন-মেজাজের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। যে কারণে যারা নাইট শিফটে কাজ করেন, পর্যাপ্ত দিনের আলো থেকে বঞ্চিত, তারা অনেকসময় বিষণ্নতায় ভুগতে পারেন।

শীতপ্রধান দেশের মানুষ যারা সূর্যের আলো কম পায় তাদের সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার বা স্যাড বলে একটা মানসিক অবস্থা এ কারণেই তৈরি হয়। বলা হয়, ইউরোপের ২-৮% মানুষ এই স্যাডে আক্রান্ত।

তাদের চিকিৎসায় একধরনের উজ্জল আলো ব্যবহার করা হয়, যা স্যাড ল্যাম্প বলে পরিচিত যা দেখতে দিনের আলোর মতোই।

সকালবেলা আধাঘন্টার মতো এরকম আলোতে কাটালে দেহঘড়ির ছন্দ ঠিক হয়ে যায় এবং মানসিক অবস্থা ভালো হয়।

সূর্যের আলো আমাদের হাড় শক্ত রাখতে সাহায্য করে

যখন আমাদের দেহত্বকে রোদ এসে পড়ে, তখন শরীর সেখান থেকে ভিটামিন ডি তৈরি করে।

বিভিন্ন খাবার থেকে ক্যালসিয়াম এবং ফসফেট আমাদের শরীরে শোষণ করতে সাহায্য করে সূর্যালোক।

আমাদের হাড়, দাঁত এবং পেশীকে শক্ত ও সুস্থ রাখতে যা খুবই দরকার।

ভিটামিন ডি-র অভাব হলে হাড় দুর্বল এবং নরম হয়ে পড়ে, নানা সমস্যা দেখা দেয়।

তাই সুযোগ পেলেই, শরীরটা মেলে দিন রোদের নিচে। ১৫ মিনিট থেকে আধ ঘণ্টামতো থাকুন। সূর্যালোকের সংস্পর্শ পেতে সমুদ্রসৈকতে ছুটতে হবে- এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই!

তবে খেয়াল রাখবেন-সূর্যের তেজ যদি বেশি হয় (সাধারণত দুপুরের দিকে) তখন রোদে না যাওয়াই ভালো। আর সুযোগ থাকলে সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে পারেন। ত্বকের ক্ষতি তাতে কম হবে।