published : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
যাকাত ইসলামের এমন একটি বিধান, যা অতীব গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ-ব্যাপারে সচেতনতা কম, সচেতন হওয়ার চেষ্টাও কম। ফল অনেকে নামকাওয়াস্তে যাকাত আদায় করেন যথাযথ হিসাবনিকাশ ছাড়া। আবার অনেকেই যাকাত দেন ব্যক্তিগতভাবে, পরিচিত হতদরিদ্রদের মধ্যে শাড়ি লুঙ্গি ইত্যাদি বিতরণের মাধ্যমে। অথচ এভাবে যাকাত আদায় বিধানসম্মত নয়। তাই জানতে হবে যাকাত আদায়ের সঠিক পদ্ধতি, যাকাত দিতে হবে সেই পদ্ধতি মোতাবেক।
কোনো ধর্মের বিধিবিধান সঠিকভাবে বুঝতে হলে জানতে হবে ঐ ধর্মের প্রবর্তক বা প্রচারক কিভাবে তা চর্চা করেছেন। ইসলামের নীতিমালার মূল নায়ক হচ্ছেন নবীজী (স)। অতএব, তিনি কোনো কাজ যেভাবে করেছেন সেভাবে করাই হলো সঠিক পদ্ধতি।
নামাজ ফরজ হওয়ার পরে নবীজী (স) ও তার অনুসারীরা নামাজ আদায় শুরু করেন। রোজা ফরজ হওয়ার পর সবাই যার যার মতো রোজা রাখতে লাগলেন। কিন্তু যাকাত ফরজ হওয়ার পরে নবীজী (স) বা তার সাহাবারা কেউ তার যাকাতের অর্থ বা খেজুর নিয়ে বের হয়েছেন বা কাউকে যাকাত নিতে ডেকেছেন তা কিন্তু না। কারণ যাকাত এ পদ্ধতিতে আদায় করা হয় নি।
দ্বিতীয় হিজরিতে যাকাত ফরজ হওয়ার পর রসূলুল্লাহ (স) যাকাত ফান্ড গঠন করেন। তিনি যাকাতের জন্যে কর্তৃপক্ষ ঠিক করে দেন। তারপর ঘোষণা এসেছে, যাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ আছে তাদের যাকাত দিতে হবে। সময়মতো যাকাতের সম্পদ প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে, যাতে যাকাত আদায়কারী কর্তৃপক্ষ গেলে সেটা তাদের দিতে পারে। তবে কেউ চাইলে কেন্দ্রে এসেও যাকাত জমা দিতে পারবে।
এরপর আবার ঘোষণা দিয়ে যাকাত যারা পেতে পারে তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং তালিকা ধরে ধরে তাদের কাছে যাকাত পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে সঙ্ঘবদ্ধভাবে যাকাত আদায় করাই হলো নবীজীর (স) দেখানো পদ্ধতি।
উত্তর হলো, না! যাকাতদাতাকে ব্যক্তিগতভাবে যাকাত বিতরণ করার এখতিয়ার দেয়া হয় নি।
যাকাত আদায়ের একটি ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি সমাজে চালু আছে, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ ব্যক্তিগতভাবে যাকাত হিসাব করেন এবং ভিক্ষার মতো করে যাকাত দেন, যা দিয়ে কেউ স্বাবলম্বী হতে পারে না। ব্যক্তিগতভাবে যাকাতের মাধ্যমে কাউকে স্বাবলম্বী করাটা আসলে কঠিনও। যে-কারণে দেখা যায় একই ব্যাক্তি বছরের পর বছর যাকাত নিচ্ছেন, কিন্তু স্বাবলম্বী হতে পারছেন না।
বলতে পারেন, আমি কি অমুক জায়গায় যাকাত দিতে পারব? জবাব হলো- যাকাতের মূলনীতি একটিই! আপনি যাকাত দেবেন যাকাত ফান্ডে। যাকাত কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবে এটি কোথায়, কতটুকু ব্যয় করা হবে।
আপনি কতৃপক্ষকে আপনার পরামর্শ ও মতামত অবশ্যই জানাতে পারেন। কিন্তু আপনার ওপর যে যাকাতটুকু ফরজ হয়েছে সেটি কাকে দেয়া হলো, কাকে দেয়া হলো না এই প্রশ্ন করার অধিকার আপনাকে দেয়া হয় নি। আপনি শুধু একটি প্রশ্নই করতে পারেন, কোন জায়গায় দেবো? কোন ফান্ডটি গ্রহণযোগ্য?
হিজরী একাদশ সনে হযরত মা'আজ ইবনে জাবালকে (রা) যখন ইয়ামেনের গভর্নর করে পাঠানো হয়, তখন রসূলুল্লাহ (স) একটি দীর্ঘ নীতিমালা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি তাকে একটি একটি করে নির্দেশনার বাস্তবায়ন করতে বলেছিলেন- প্রথমে তুমি কালেমা বা বিশ্বাসের দাওয়াত দেবে। যদি অধিবাসীরা তা মেনে নেয় তখন নামাজের দাওয়াত দেবে। যদি তাও মেনে নেয় তারপরে যাকাতের কথা বলবে। যাকাত ধনীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করবে এবং গরীবদের মধ্যে বিতরণ করবে।
এখানে ব্যক্তিগতভাবে যাকাত আদায়ের কথা বলা হয় নি।
আবার নবীজী (স) একবার যাকাত সংগ্রহকারীদের নির্দেশনা দেন, তোমরা যাকাতদাতাদের ভালো ভালো জিনিসগুলো আনবে না। গড়পড়তা করে ভালো-মন্দ মিলিয়ে আনবে। আবার যাকাতদাতাদেরকে নির্দেশনা দেন, যখন যাকাত সংগ্রহকারীরা যাবে তখন তোমরা বেছে বেছে কেবল খারাপ মালগুলো দেবে না। (যাকাত বলতে শুধু টাকা পয়সা বোঝায় না, ফল-ফসল, উট-বকরীও বোঝায়।)
অর্থাৎ, একাকী যাকাত দিতে গিয়ে বেছে বেছে খারাপগুলোই দেবার যে মানসিকতা কারো কারো মধ্যে তৈরি হতে পারত, সেই সম্ভাবনাটা দূর হয়েছে এই নির্দেশনার মাধ্যমে।
ছোটবেলা থেকে আমরা যাকাত নিয়ে নানারকম সামাজিক প্রথা দেখে অভ্যস্ত। এজন্যে যাকাত বিষয়টা অনেকের কাছেই হালকা বা কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। অথচ বছর শেষে সুক্ষ্মভাবে হিসাব-নিকাশ করে যাকাত আদায় করা নামাজের মতোই ফরজ বা অলঙ্ঘনীয় বিধান। অতএব, নামাজ রোজা যেভাবে যথাযথভাবে আদায়ের দিকে আমরা মনোযোগ দেই, একই রকম মনোযোগ দিতে হবে যাকাতের ক্ষেত্রেও।
আসলে ধর্মের কোনো বিধানই লোক দেখানো হলে চলবে না; যাকাতও তাই। আমরা যে ভাবি, অমুককে যাকাত না দিলে মন খারাপ করবে- যাকাত কিন্তু কারো মন রক্ষার ব্যাপার না।
যাকাত কোন ভিক্ষাও নয়। যাকাত হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের একটি নির্ভরযোগ্য প্রক্রিয়া। যত সহীহভাবে আমরা যাকাত আদায় করব ততো পূর্ণ হবে যাকাতের এই উদ্দেশ্য।
আলোচনাটি শুনলে যাকাত সম্পর্কে আপনার অনেক ভুল ধারণারই অবসান ঘটবে