published : ৩১ জুলাই ২০২৫
একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, লোনলিনেস- শব্দগুলো শুনলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে দাদা-দাদী, নানা-নানীর বয়স্ক চেহারা। কিন্তু বর্তমানে একাকিত্বে ভোগা মানুষের কাতারে শামিল হয়েছে তরুণ, এমনকি শিশুকিশোররাও।
বাবা-মা, ভাই-বোন, অর্থাৎ পরিবারের মধ্যে থেকেও এরা চরম একাকী। এ যেন একাকিত্বের মহামারি!
আসুন, খতিয়ে দেখা যাক কিছু কারণ-
গ্রাম এবং মফস্বল শহরে সবাই একে অন্যকে চেনে; আনন্দ-উল্লাস, দুঃখ-বেদনায় কাউকে না কাউকে তারা পাশে পায়। কিন্তু শহুরে জীবনে ‘প্রাইভেসি’র অজুহাতে আমরা নিজেদের করে ফেলেছি বিচ্ছিন্ন-একাকী।
পাশের ফ্ল্যাটে কারা থাকে সেটা-ই জানে না অনেকে!
বর্তমানে একক পরিবার সংস্কৃতিতে আছি আমরা, যেখানে মন খুলে কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া হয়ে গেছে দুষ্কর।
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হলে এবং তাদের এক বা দুজনই চাকুরিজীবী হলে তো কথা-ই নেই!
তথাকথিত সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে এতটাই বুঁদ হয়ে গেছে যে, প্রিয়জনের সাথে সরাসরি যোগাযোগের প্রয়োজনই মনে করছে না। ভার্চুয়াল তথা বায়োবীয় সংযোগ যেহেতু মমতার পরশ দিতে পারে না, তাই এই মানুষগুলো হয়ে পড়ছে বিচ্ছিন্ন-একাকী-নিঃসঙ্গ।
বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ-তনয় আরিয়ান খান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাবার সাথে দেখা করতেও নাকি তাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়! এর পরিণতি কী তা আমরা আরিয়ানের মাদক কেলেঙ্কারি এবং উচ্ছৃঙ্খল জীবনাচার থেকে বুঝতে পারি।
আসলে ব্যস্ততার অজুহাতে সন্তানকে সময় দেন না অনেক বাবা-মা। দিনশেষে ঘরে ফিরে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েন সিরিয়াল, টকশো, নিউজ ফিড, স্মার্টফোন নিয়ে। ফলে সারাটাক্ষণ পাশে থেকেও কোয়ালিটি সময় পায় না সন্তান। এতে পারিবারিক বন্ধন ঢিলে হয়ে যায়। নিজ নিজ অবস্থানে প্রত্যেকেই হয়ে পড়ে একাকী।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা সার্জন জেনারেল ডক্টর বিবেকমূর্তি হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ পত্রিকায় একটি নিবন্ধে একাকিত্বের পরিণতি সবিস্তারে তুলে ধরেনঃ
ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যগত মহামারি!
একাকিত্বকে তিনি বলেছেন growing health epidemic বা ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যগত মহামারি! ৪০ শতাংশের বেশি মার্কিন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক একাকিত্বে ভুগছে। একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে কিশোর-কিশোরীরা ঝুঁকে পড়ছে সহিংসতা, ড্রাগ ও গ্যাংকালচারের দিকে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, এই ঝুঁকিতে আছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের শিশু-কিশোর, এমনকি আমরাও!
বাড়ায় দৈহিক ও স্নায়ুবিক স্ট্রেস
সৃষ্টির আদি থেকেই যূথবদ্ধতা মানুষকে রেখেছে নিরাপদ, সুরক্ষা দিয়েছে হিংস্র প্রাণীসহ পারিপার্শ্বিক নানা বিপদাপদ থেকে। হাজার বছর ধরে একতাবদ্ধতার এই দিকটিই লিপিবদ্ধ হয়ে আছে আমাদের নার্ভাস সিস্টেমে।
তাই যখন আমরা নিঃসঙ্গ থাকতে শুরু করি তখন আমাদের দেহমনে সৃষ্টি হয় স্ট্রেস, যা বাড়িয়ে দেয় কর্টিসলের প্রবাহ। এতে শরীরে এক ধরনের প্রদাহ সৃষ্টি হয়।
অসুস্থতার কারক
নানাবিধ অসুস্থতার মূলে রয়েছে এই স্ট্রেসজনিত প্রদাহ।
হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের একটি বড় উৎস একাকিত্ব। ডিমেনশিয়া, ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটির সাথেও একাকিত্ব জড়িত ওতপ্রোতভাবে।
নিঃসঙ্গতা মানুষকে শুধু অসুস্থই করে না, রোগ নিরাময়কেও করে তোলে দুরূহ।
কমায় আয়ু!
একাকিত্ব ও দুর্বল সামাজিক যোগাযোগ মানুষের আয়ু কমিয়ে দিতে পারে।
দিনে ১৫টি সিগারেট খেলে যে পরিমাণ আয়ু কমে, একাকিত্ব কমায় সেই পরিমাণ আয়ু!
একাকিত্ব রোধে সোশ্যাল ফিটনেস বাড়াতে হবে। এজন্যে কিছু করণীয়ঃ
২০১৭ সালে আমেরিকান জার্নাল অব এপিডেমিওলজিতে প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়, ফেসবুকে একজন মানুষ যত সময় কাটাবে তত কমবে তার মানসিক প্রশান্তি, বাড়বে একাকিত্ব। আর এজন্যে তারা পরামর্শ দিচ্ছে ফেসবুক টুইটার টিকটকসহ সকল সোশ্যাল মিডিয়া বর্জনের।
মনোবিজ্ঞানীরা এখন একাকিত্ব নিরসনে বাস্তব সামাজিক যোগাযোগ বাড়াতে বলছেন।
স্কুল-কলেজে ভ্যাকেশন কিংবা চাকুরিতে লম্বা ছুটি, আমরা এখন ছুট লাগাই দেশ-বিদেশের ট্যুরিস্ট স্পটে। এর বদলে এ-সময়টাতে আমরা আত্মীয় বাড়ি বেড়িয়ে আসতে পারি।
আর বাসায় কেউ বেড়াতে এলে পরিবারের ছোট্ট সোনামণিকে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন। এতে সে সামাজিক হয়ে উঠবে।
সালাম একাকিত্বের প্রতিষেধক- কথাটি শুনে আপনি মুচকি হাসতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সোশ্যাল ফিটনেস বাড়াতে সালামের জুড়ি নেই!
সম্প্রতি আমেরিকায় একটি মিডিয়া ক্যাম্পেইন বেশ জনপ্রিয় হয়েছে- ‘Just say hello!’ পরিচিত হোক বা অপরিচিত, যার সাথেই দেখা হবে তাকেই ‘হ্যালো’ বলো!
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কগনিটিভ এন্ড নিউরোসায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক জন কাসিওপ্পো ২০ বছর ধরে নিঃসঙ্গতা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, “পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে হ্যালো বলার অভ্যাস তোমার সোশাল মাসল বাড়াবে!”
এই ‘জাস্ট সে হ্যালো’র মূলে রয়েছে নবীজীর (স) শিক্ষা!
১৪০০ বছর আগে তিনি বলে গেছেন, সর্বত্র সালামের প্রচলন করো। (প্রথম সুযোগেই আগে সালাম দাও।) তোমরা লাভ করবে শান্তি ও নিরাপত্তা! (বারা ইবনে আজিব (রা); আহমদ, মুফরাদ)
ইতিবাচক এবং কল্যাণমুখী সঙ্ঘে সংযুক্ত হয়ে আপনি সোশ্যাল ফিটনেস বাড়াতে পারেন।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন তেমনই একটি সৎসঙ্ঘ। আপনি কোয়ান্টাম মেথড ও মেডিটেশন চর্চা করে আত্মউন্নয়ন ঘটাতে পারবেন যেমন, তেমনি পারবেন দুঃস্থ মানুষের জন্যে কিছু করতে। আর এই দুইয়ে মিলে নাশ হবে একাকিত্ব, জোরদার হবে আপনার সোশ্যাল ফিটনেস।