সামর্থ্যবান মানুষের জন্যে ঈদুল আজহায় গবাদি পশু কোরবানি করা ওয়াজিব। ফলে দিনটায় প্রত্যেক সামর্থ্যবান মানুষই নিজ নিজ পছন্দমতো গরু ছাগল ভেড়া ইত্যাদি কোরবানি করে থাকেন। কেউ কেউ কোরবানি করেন একাধিক পশু।
ঘটনাটি আমরা সবাইই জানি। একদিন হযরত ইবরাহীম (আ) স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি কোরবানির নির্দেশ পান। তিনি ১০টি উট কোরবানি করেন। একই স্বপ্ন আবার দেখলে এবার তিনি কোরবানি করেন ১০০ উট।
কিন্তু তারপরও স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি হলে এবার ইবরাহীম (আ) চিন্তা করলেন তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কোনটি। পুত্র ইসমাইল ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। আল্লাহ্র নির্দেশ পরিপালন করতে তিনি নিজ সন্তানকে কোরবানি করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু আল্লাহ্র নির্দেশে কোরবানি হয় একটি দুম্বা।
সেই থেকেই কোরবানির শুরু। আজও মানুষ প্রতি ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি করেন স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য এবং তাঁর যে-কোনো নির্দেশ কৃতজ্ঞচিত্তে শুকরিয়ার সাথে গ্রহণ করার মানসিকতাকে জোরদার করতে।
আত্মপরতা-স্বার্থপরতা ঘুচিয়ে পরস্পরের প্রতি, সমাজের সবার প্রতি সমমর্মিতা সৃষ্টিই কোরবানির উদ্দেশ্য।
সূরা হজের ৩৬নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, কোরবানির পশু যখন জমিনে লুটিয়ে পড়ে, তখন তা থেকে (মাংস সংগ্রহ করে) তোমরা খাও এবং কেউ চাক না চাক সবাইকে খাওয়াও।
আর সূরা হজের ২৮নং আয়াতে বলা হয়েছে, জবাই করা পশু থেকে তোমরা খাও এবং অভাবী দরিদ্রদের খাওয়াও।
অর্থাৎ, কোরবানির পশুর মাংস ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে অভাবী সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে বিতরণ করার সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে পবিত্র কোরআনে।
কোরবানির মাংস তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজে খাওয়ার জন্যে রেখে এক ভাগ দরিদ্রদের মধ্যে এবং এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিতরণ করতে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো ইচ্ছা সত্ত্বেও অনেক সময় এভাবে মাংস বিতরণ করতে পারি না আমরা।
কারণ বিশেষত শহরাঞ্চলে আশেপাশের সকল দরিদ্রের খোঁজখবর আমাদের কাছে থাকে না। আর যোগাযোগের অভাবে এবং লোকবল ও পরিবহনের অসুবিধাজনিত কারণে সব আত্মীয়ের মধ্যে বিতরণ করাও হয়ে ওঠে না অনেকের।
এ-কারণে বিতরণের অধিকাংশ মাংস এক শ্রেণীর পেশাদার ভিক্ষুক বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে, যার বড় অংশই তারা বিক্রি করে দেয় হোটেল-রেস্তোরাঁয়।
অর্থাৎ, কোরবানির মাংসের হকদারের একাংশ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি পাচ্ছে, আর একাংশ পাচ্ছে না কিছুই! ফলে সবাই মিলে কোরবানির মাংস খাওয়ার তৃপ্তি ও আনন্দ হতে বঞ্চিত থেকে যায় সমাজের বিপুল সংখ্যক মানুষ।
কোরবানির মাংসে সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রত্যন্ত বান্দরবানের লামায় ২০০২ সাল থেকে আয়োজন করা হয় ‘কোরবানি উৎসব’। ২০১০ সাল পর্যন্ত এই কার্যক্রমের মাধ্যমে এমন হাজারো পরিবারের কাছে নিয়মিত পৌঁছানো হয়েছে কোরবানির মাংস, যাদের কেউ কেউ কখনো মাংস খায় নি। কারো কারো মাংস জোটে বছরে এই একবারই।
বাংলাদেশে কিছু মানুষের বিস্তর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাঝে কিছু মানুষ হয়ে পড়েছেন আর্থিকভাবে দুর্বল। শহরাঞ্চল, যেখানে এমনকি পাশের ফ্ল্যাটে কারা থাকে সেই খোঁজ রাখার সময়টুকুও অনেকের হয় না, সেখানে এই বিশেষ শ্রেণীর মানুষ খুব অসহায়। না পারে এরা কোরবানির মাংসের জন্যে কারো দোরগোড়ায় যেতে, না অন্যরা খুঁজে খুঁজে তার পর্যন্ত মাংস পৌঁছায়।
এই বিশেষ শ্রেণীর মানুষের কথা মাথায় রেখে ২০২৩ সালে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কয়েকজন সক্রিয় কর্মীর উৎসাহে কোরবানির ব্যবস্থা করা হয় দেশের বেশ কিছু জায়গায়। এরপর সীমিত করসেবার মাধ্যমে খুঁজে খুঁজে কোয়ান্টাম পরিবারের সেসব সদস্যের ঘরে মাংস পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়, যারা যত অভাবই থাকুক না কেন কারো কাছে কখনো কিছু হাত পেতে নিতে পারেন না।
ঈদের দিন কোরবানির মাংস পেয়ে অনেকেই উচ্ছ্বসিত আনন্দ ব্যক্ত করেন। মমতার পরশে কেঁদে ফেলেন কেউ কেউ।
আসলে আমরা দাতা জাতি, ধর্মীয় ব্যাপারে খরচ করতে আমাদের উৎসাহের অন্ত নেই। দেশের মানুষের আর্থিক সামর্থ্য বাড়ার সাথে সাথে কোরবানির সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ছে।এখন প্রয়োজন কোরবানির সামাজিকায়ন।
অর্থাৎ, সুন্দর একটি বিতরণ ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে কোরবানির মাংস পৌঁছে যাবে অভাবী নিরন্ন বঞ্চিতের ঘরে। আর এমন মহতী উদ্যোগ সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে কোয়ান্টামের জুড়ি নেই!
বর্তমান বাজারে মোটামুটি মানের একটি গরু কেনা থেকে শুরু করে কোরবানি পরবর্তী মাংস প্রক্রিয়াকরণ- সব মিলে খরচ পড়ে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। একটি গরু কোরবানি দেয়া যায় সাত নামে। এই হিসেবে এক ভাগের খরচ পড়ে প্রায় ২১ হাজার টাকা।
টাকাটা আপনি ফাউন্ডেশন দান করে দিতে পারেন। আপনার মতো শত-সহস্র মানুষের দান করা অর্থ থেকে পশু কিনে কোরবানি দেয়া হবে। এরপর মাংস বিতরণ করা হবে দুঃস্থদের মাঝে।
অবশ্য আপনি চাইলে নিজে কোরবানি দিয়ে যে-কোনো পরিমাণ মাংস পৌঁছে দিতে পারেন ফাউন্ডেশনে। ফাউন্ডেশন আপনার হয়ে তা পৌঁছে দেবে যথার্থই এর হকদার যারা সেই অভাবী দুঃস্থ বঞ্চিতের ঘরে।
কোরবানি পরিণত হয়েছে এক সামাজিক অনুষ্ঠানে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সেন্টার-শাখা-সেলগুলোতে শত শত সামর্থ্যবান সদস্য সমবেতভাবে পশু কোরবানি দিচ্ছেন। হাজার হাজার কোয়ান্টিয়ার করসেবার মাধ্যমে কোরবানির মাংস পৌঁছে দিচ্ছেন যারা কোরবানি দিতে পারেন নি চারপাশের এমন সকল ঘরে।
এবার থেকে শুরু করে যদি দশটি বছর আমরা এভাবে পশু কোরবানি দেই তাহলে দেখা যাবে সত্যি সত্যিই মনছবি বাস্তবরূপ নিয়েছে।