published : ২ অক্টোবর ২০১৭
নদীমাতৃক বাংলাদেশের চিরাচরিত প্রবাদ ‘মাছে-ভাতে বাঙালি'। এখানে ইলিশ পরিচিত মাছের রাজা হিসেবে। দেশটিতে চার শ প্রজাতির অধিক মাছ পাওয়া গেলেও মোট উৎপাদিত মাছের এক দশমাংশের বেশি হলো ইলিশ। এ মাছটির গায়ে রুপালি আঁইশ যুক্ত আছে বলে একে রুপালি ইলিশও বলা হয়।
ইলিশ মূলতঃ লবণাক্ত পানির মাছ বা সামুদ্রিক মাছ। বেশিরভাগ সময় সে সাগরে থাকে কিন্তু বংশবিস্তারের জন্যে প্রায় ১২০০ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে ভারতীয় উপমহাদেশের নদীতে পারি জমায়। তাছাড়া বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের পলিবিধৌত মহীসোপান হলো ইলিশের শ্রেষ্ঠ চারণভূমি। এজন্যে পৃথিবীর ১২টি দেশে ইলিশের প্রাপ্তি হলেও, মোট পরিমানের ৭০ শতাংশই বাংলাদেশে পাওয়া যায়।
মা ইলিশ বছরে দু’বার ডিম দেয়। অধিকাংশরা সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এবং বাকীরা ফেব্রুয়ারি-মার্চ ও এপ্রিল মাসে। একটি মা ইলিশ প্রতি মৌসুমে একবারে সর্ব্বোচ্চ ১ থেকে ২.৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ১০ থেকে ২৩ লক্ষ পরিমাণ ডিম পাড়ে এবং নাসিং গ্রাউন্ডে সারাক্ষণ ডিমের পরিচর্যা করে। সদ্য প্রসুত ডিমগুলোকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে কখনো কখনো তা মুখে পুরে সাথে নিয়েও ঘুরে বেড়ায়। ডিম থেকে বাচ্চা না ফোটা ও সাঁতার শেখা পর্যন্ত মা ইলিশের পরিচর্যা চলতে থাকে।
সাঁতার দেয়ার উপযোগী হয়ে উঠলে বাচ্চারা মা ইলিশের সাথে সাঁতার কেটে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ায়। শিশু ইলিশদের লালন পালনে বাবা ইলিশও ভূমিকা রাখে। মা ইলিশ যখন বাচ্চাদের রেখে খাদ্যান্বেষণে যায় তখন বাবা ইলিশ তাদের দেখাশোনা করে।
এত পরিচর্যার পরও মাত্র ১০-২০ শতাংশ জাটকা সমুদ্রের নোনা পানিতে সঠিকভাবে বেড়ে উঠার সুযোগ পায়। কারণ ডিমের প্রায় ৩০ শতাংশ অন্যান্য মাছ ও প্রাণীদের আহারে চলে যায়। ১০ শতাংশ অপুষ্ঠিজনিত কারণে শুরুতেই নষ্ট হয়ে যায়। পরে প্রায় ২০ শতাংশ পোনা এবং ৩০ শতাংশ জাটকা হিসেবে জেলেদের জালে ধরা পড়ে। বলা হয়, যদি ৫০ শতাংশ ডিমও যথার্থভাবে বেড়ে উঠতে পারত তাহলে বঙ্গোপসাগরের অর্ধেকটা ইলিশের দখলে চলে যেত।
ইলিশ পোনা ৬-১০ সপ্তাহে ১২ সেমি থেকে ২০ সেমি পর্যন্ত বড় হয়। তখন তাদের জাটকা বলে। একটি জাটকা মাছ পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিণত হতে সময় নেয় ১ থেকে ২ বছর। তখন আয়তনে ৩২ সেমি থেকে ৬০ সেমি এবং ওজনে ১ থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। জাটকারা মা ইলিশের সাথে সমুদ্রে চলে যায়। সেখানে পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিণত হয়ে আবার প্রজনন কালে নদীতে ফিরে আসে।
বাংলাদেশে গত এক দশক পূর্বে ইলিশের প্রাপ্তি কম হলেও বর্তমানে প্রতিবছর ইলিশের প্রাচুর্য বাড়ছে। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ইলিশের প্রাপ্তি ১.৯১ লাখ টন থাকলেও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ইলিশের প্রাপ্তি ছিল ৩.৮৫ লাখ টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৩.৮৭ লাখ টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৩.৯৭ বা প্রায় ৪ লাখ টন। গণমাধ্যমগুলোতে নিয়মিত খবর আসছে, এবছর যেভাবে মাছ ধরা পড়ছে তাতে ইলিশের উৎপাদন হতে পারে ৫ লাখ মেট্রিক টনের কাছাকাছি।
বলা হচ্ছে, সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ যেমন, মা ইলিশ রক্ষায় চন্দ্রের হিসেবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ২/৩ সপ্তাহ (১৫/২২ দিন) জাল ফেলার উপর নিষেধাজ্ঞা, জাটকা সংরক্ষণের জন্যে নভেম্বর থেকে মে/জুন মোট ৭/৮ মাস জাটকা (২৫ সেমির কম) ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা, মাছের অভয়াশ্রম বাস্তবায়ন, কারেন্ট জাল সহ ছোট খোপের জাল (nets of small holes) ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের কারণে এমন ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে।
ইলিশ সম্পদ রক্ষায় কোয়ান্টাম পরিবার একটি সুদূর প্রসারী ছোট্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় ২০১৩ এর ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ বাংলা ১৪২০ সালের পয়লা বৈশাখের দিন নববর্ষের মেন্যুতে নিজেরা ইলিশ বর্জন করবে। এবং তখন থেকে তারা পয়লা বৈশাখের দিন নববর্ষের মেন্যুতে ইলিশ বর্জন করে আসছে কারণ বৈশাখ বরণের নামে পান্তা ইলিশ খাবার ভুল সংস্কৃতি বন্ধ হলে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ইলিশ শিকারের প্রবনতা কমে আসবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মা ও জাটকা ইলিশ রক্ষা পাবে।
কোয়ান্টাম সদস্যরা ইলিশের বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছে পান্তাপিয়ার রেসিপি অর্থাৎ পানিভাত, আস্ত তেলাপিয়া ভাজা, ভাজা আলুকুচি, মরিচ আর পেঁয়াজ ইত্যাদি। তারা নিজেদের বাইরে পরিচিত পরিমণ্ডলেও ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের চিন্তাকে। ফলে বিষয়টি নিয়ে দায়িত্বশীল মানুষদের মধ্যে নানাভাবে পর্যালোচনা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, সেলিব্রিটিসহ সবাই বলতে শুরু করলেন, ইলিশ বা পান্তাইলিশের সাথে বৈশাখের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রশাসন এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও ঘোষণা করে ২০১৬ ও ২০১৭ পর পর দুই বছর পয়লা বৈশাখে ইলিশ বর্জন করলেন।
পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, বর্তমানে দেশে ইলিশ বান্ধব একটি পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। মৎস শিকারী ও ভোক্তা সবাই ইলিশের প্রতি আরো আন্তরিক ও দায়িত্বশীল আচরণ করতে শুরু করেছেন। ফলে ইলিশের উৎপাদন এবং গড় ওজন বাড়ছে। তারা অনেকে এ বিষয়টিকে বিবেচনা করছেন প্রকৃতির প্রতিদান হিসেবে। বলছেন, প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সত্যিকারের সমমর্মী হলে, প্রকৃতিও সবসময় ত্বরিত ইতিবাচক সাড়া দেয়।
সূত্র:
১. ইলিশের কথা ~আব্দুল আজিজ(আজীজ আহমেদ)
৩. পয়লা বৈশাখে ইলিশ খাবেন না প্রধানমন্ত্রী
৪. পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাবেন না: প্রধানমন্ত্রী