প্যারেন্টিং কখন থেকে শুরু করবেন?

published : ২৭ নভেম্বর ২০২৫

একজন চাষী ধান চাষের জন্যে কিছু প্রস্তুতি নেন। প্রথমেই ধানবীজ ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখেন। এরপর বীজতলায় সেগুলো বপন করেন। অঙ্কুরোদগমের পর চারা কিছুটা বড় হলে চাষের জমি তৈরি করে জমিতে সেগুলো রোপন করেন। এরপর ফসল যেন ভালো হয় সেজন্যে নিয়মিত গাছের পরিচর্যা করেন।

একজন দক্ষ চাষীর মতো ভালো ফসল পেতে চাইলে বাবা-মা হিসেবে প্যারেন্টিং শুরু করতে হবে শিশু পরিকল্পনা পর্যায় থেকেই।         

তাই হবু বাবা-মায়েরা প্রথমেই নিজেকে নিচের প্রশ্নগুলো করুন 

  • আপনি কি শিশুর যত্নের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত?
  • আপনার কি শিশু লালনের জন্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ (সময়, অর্থ, সাপোর্ট) আছে? 
  • আপনি কি প্যারেন্টিংকে অগ্রাধিকার দিয়ে অবিরাম শেখার জন্যে প্রস্তুত? 
  • শিশুর বড় হওয়ার সাথে সাথে প্যারেন্টিং পদ্ধতি পরিবর্তন করতে প্রস্তুত?

উপরোক্ত চারটি প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয় তবে নিম্নোক্ত প্যারেন্টিং পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করুন; আপনার সন্তান হবে মেধাবী ও সফল।   

প্যারেন্টিং আসলে হুট করে শুরু করার মতো বিষয় নয়। বরং এর জন্যে প্রয়োজন প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতি হলো একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা সন্তান জন্মের আগেই শুরু করা উচিৎ। 

১. গর্ভধারণের আগে (পরিকল্পনা পর্যায়)

আমরা বাবা-মা হতে চাই- এই চিন্তাটা আসার মুহূর্ত থেকেই প্যারেন্টিং শুরু করা উচিৎ। এজন্যে পরিকল্পিত এবং আকাঙ্ক্ষিত সন্তান যেন হয় এই দিকে বিশেষ মনোযোগ দিন। 

গর্ভধারণের আগে মানসিক, আর্থিক এবং আচরণগত প্রস্তুতিরও প্রয়োজন। তাই এই ব্যাপারে দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিন। কে কী দায়িত্ব নেবেন মন খুলে আলাপ করুন। 

জেনেটিক রিসার্চ বলছে, সন্তান কনসিভ হবার আগেই যেন বাবা-মা মনেপ্রাণে সুস্থ সুন্দর ও বুদ্ধিমান সন্তানের প্রত্যাশা করে। এই প্রত্যাশা সুস্থ স্বাভাবিক সন্তান লাভে সহায়ক হয়।   

তাই বিশ্বাসী, সৎকর্মশীল, মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রমী সন্তানের জন্যে মনছবি দেখুন। 

২.গর্ভাবস্থা

প্যারেন্টিং-এর দ্বিতীয় প্রক্রিয়া শুরু হয় গর্ভাবস্থায়। অর্থাৎ যখন একজন নারী জানতে পারেন যে, তিনি সন্তান ধারণ করেছেন।

তাই এসময় হবু বাবা এবং পরিবারের অন্যান্যদের কর্তব্য হচ্ছে প্রসব হওয়া পর্যন্ত সন্তানসম্ভবাকে উৎফুল্ল রাখা, মানসিকভাবে প্রশান্ত থাকতে সহযোগিতা করা। একজন গর্ভবতীকে যত উৎফুল্ল রাখতে পারবেন, বাচ্চা তত বুদ্ধিমান, খোশমেজাজ এবং প্রজ্ঞাবান হবে। কারণ গর্ভাবস্থাতেই সন্তানের আবেগজনিত কাঠামোতে বড় রকমের প্রভাব ফেলে চারপাশের পরিবেশ। 

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘পেটের শিশু কিচ্ছু বোঝে না’- এই কথাটি ভুল। ভ্রুণাবস্থাতেই শিশু সব শোনে, সব বোঝে। মায়ের মুড, চিন্তা চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সে প্রভাবিত হয়। মা যদি আনন্দে থাকেন, বাচ্চার মধ্যে সে আনন্দের অনুভূতি সঞ্চারিত হয়। মা যদি কষ্টে থাকেন, কষ্টের অনুভূতি সঞ্চারিত হয়। মা যদি গীবত করেন, সেই গীবতের নেতিবাচক প্রভাব তার মধ্যে পড়ে। 

কারণ হিসেবে গবেষকরা মনে করেন, জন্মের পর শিশুটি যেন তার পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে, তাই প্রকৃতি মায়ের পেটেই শিশুকে সেই পরিবেশে অভ্যস্থ করে তোলে। চারপাশের যে-সব তথ্য মা শোনেন, অনুধাবন করেন তা-ই আম্বিলিকাল কর্ডের (Umbilical cord) মাধ্যমে শিশুর কাছে গিয়ে পৌঁছায়। আর এই তথ্যানুসারেই ভ্রুণাবস্থা থেকেই গড়ে ওঠে শিশুর দৈহিক গঠন ও মানসিক ভিত্তি।   

শিশুর গর্ভাবস্থায় বাবা-মা ও অভিভাবক হিসেবে কিছু করণীয়  

  • সবসময় ভালো কথা বলুন, ভালো চিন্তা করুন
  • ধর্মগ্রন্থ পড়ুন
  • শিশুর যত্ন, গর্ভাবস্থা এবং স্তন্যদান সম্পর্কে জানুন, শিখুন
  • মা-বাবা/অভিভাবক হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালন নিয়ে আলোচনা করুন
  • সৎকর্ম করুন 
  • ফেসবুকসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পুরোপুরি বর্জন করুন
  • অপ্রয়োজনে স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধ করুন
  • দিনে দু’বেলা মেডিটেশন করুন (শিথিলায়ন ও মনছবি)

৩. শিশুর জন্ম

শিশু জন্মের পর প্যারেন্টিং-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ শুরু হয়। এই পর্যায়ে শিশুর সুন্দর ও অর্থবাচক একটি নাম দিন। ৭ম দিতে চুল কাটুন এবং আকিকা পালন করুন। 

তিরমিজি শরীফের একটি হাদীস হলো- ছেলে বা মেয়ে হোক, জন্মের সপ্তম দিন চুল কাটা এবং চুলের ওজন পরিমাণ রূপা সদকা করা সুন্নত। 

দুজন মিলেই শিশুর প্রাথমিক চাহিদাগুলো পূরণ করার দায়িত্ব নিন। জন্মের পর থেকেই সন্তানের যত্ন নেয়া, সঠিক খাবার দেয়া এবং তার শারীরিক মানসিক বিকাশ পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। 

এবং প্রথম ছয় মাস মায়ের বুকের দুধই সন্তানকে দিন। এটিই শিশুর পুষ্টির প্রধান উৎস। 

৪. প্রথম পাঁচ বছর : নৈতিক শিক্ষার সময়কাল

শিশুর বিকাশে প্রথম পাঁচ বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসময়ে শিশুর ভাষা, সামাজিকতা এবং অনুভূতি বেশ প্রভাবিত হয়। 

তাই বাবা-মা/অভিভাবক হিসেবে সন্তানকে কোয়ালিটি সময় দিন। 

তার একটা রুটিন ঠিক করুন। শেখা ও লেখার হাতেখড়ি দিন। খেলাধুলা করুন, গল্প পড়ে শোনান, শখের বাগান করুন। তাকে ঘরের বিভিন্ন রকম কাজে যুক্ত করুন। এতে শিশুর আবেগ, ইন্দ্রিয় এবং চিন্তাশক্তি বিকশিত হবে। 

৫. কৈশোর ও তারুণ্য : রোল মডেল দিন 

এই বয়সী সন্তানকে জীবনে রোল মডেল সেট করতে উৎসাহিত করুন। সন্তানকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করুন। 

তার জীবনযাত্রার প্রতি দৃষ্টি রাখুন। সন্তানদের ব্যক্তিগত কিছু স্বাধীনতা দিন, যাতে তারা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বিকশিত করতে পারে। 

সন্তান যেন মন খুলে আপনাকে সব বলতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখুন। সন্তানের বন্ধু হওয়াটা এই বয়সে সবচেয়ে জরুরি।

এভাবে যদি প্রতিটি ধাপের প্যারেন্টিং যথাযথভাবে করেন তাহলে আশা করা যায় সন্তান হবে দায়িত্বশীল, টোটাল ফিট, ভালো মানুষ।