সুখ-অসুখ

published : ২৮ এপ্রিল ২০১২

সুখ এই কথাটার আসল অর্থ কি? কাকে আমরা সুখ বলে ভাবি? কী সেটা?

রাতদিন আমরা বলে ফিরি, এ জীবনে সুখ পেলাম না, আমার কপালে সুখ নাই, জন্মের পর থেকে সুখের মুখ দেখলাম না, এমন আরও কত কি! কিন্তু আমরা কি জানি সুখ মানে কী বা কোথায় আছে সুখ?

সুখকে আমরা যে যার মতো করে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করি। কেউ ভাবি এটা পেলে সুখী হতাম, কেউ ভাবি ওটা পেলে সুখ পেতাম। একেকজনের ভাবনা একেক রকম।

একজন ব্যবসায়ী কী চায়? টাকা। সে ভাবে যদি এক কোটি টাকার কন্ট্রাক্ট পেতাম বা টেন্ডারটা যদি মিলে যেত, তবে আমার মতো সুখী আসলেই কেউ হতো না। যারা চাকরিজীবি তারা চায় বেতন বাড়ুক বা প্রমোশন হোক।

একজন গৃহিণীর চাওয়া পাওয়ার হিসেবটা আবার অন্যরকম। সে চায় শাড়ি গয়না, নিজের একটা সংসার। কেউ জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাকলে ভাবতে থাকে, কবে হবে নিজের একটা ছোট্ট সংসার। তা না হলে আমার সুখ নাই।

সন্তান চায় স্বাধীনতা। তারা ভাবে আর কতদিন বাবা মায়ের শাসনে থাকতে হবে।

অর্থাৎ আমরা যে যার মতো করে শুধু চেয়েই যাচ্ছি অবিরত। কেউ কেউ সেই চাওয়াগুলোকে হয়তো পাওয়াতেও রূপান্তরিত করতে পারছি। কিন্তু তারপর? তারপর কি হচ্ছে? আমরা কি আসলেই সুখী হতে পারছি?

আমি নিজে আজ পর্যন্ত সুখের কোনো ব্যাখ্যা পেলাম না। ছোটবেলায় পছন্দের জামাটা যতক্ষণ না পাচ্ছি দুঃখ নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। পেলেই মনটা আনন্দে মেতে উঠত। আবার পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো হলেও মনের কোণে একটা সুখ সুখ ভাব হতো। এটার নামই কি তাহলে সুখ?

একটু বুঝতে শেখবার পর থেকে সুখের সংসার গড়বার স্বপ্ন দেখেছি। স্বামী সংসার সন্তান এসবের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেবার নাম কি তবে সুখ? একজন মেয়ে তার সমস্ত সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে সংসারের জন্যে সারাটা জীবন হাসি মুখে কাটিয়ে দেয়। কেউ কেউ হয়ত শাশুড়ি ননদের গঞ্জনা শুনে আবার স্বামীর গালমন্দ শুনেই পার করে সারাটা জীবন। হয়তো বা শুধুই বিছানার সঙ্গী হয়ে কাটিয়ে দেয় অধিকাংশ নারী।

তাদের যদি বলা হয়, কেন তোমরা সহ্য করছো?! মানুষের মত বাঁচো! তারা কি শুনবে? শুনবে না। উল্টো বলবে, তুমি কি আমার সুখের সংসারে আগুন লাগাতে চাও?  

এই যে প্রতিবাদ না করা। মুখ বুজে সহ্য করা—এ কি শুধুই সুখের সংসার বাঁচাতে? !! নাকি সমাজের অপবাদের বোঝা যাতে বইতে না হয় সেজন্যে?!

ধর্ম–তো মেয়েদের বেঁধে রাখে নি? দিয়েছে স্বাধীনতা! কিন্ত তা কি আমরা আক্ষরিক অর্থে পাচ্ছি? এই সমাজ কি আমাদের সেই অধিকার দিয়েছে?!!

বাবার বাড়িতে মেয়ে হয়ে, স্বামীর সংসারে বউ হয়ে, আর সন্তানের মা হয়ে অনেকেই নিরানন্দ জীবনের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাদের যাই হোক না কেন। নিজের মেধার বিকাশের সুযোগ সে আর পাচ্ছে না। ফলে স্বামী যদি বলে আমার টাকায় খাচ্ছো-পরছো, যেভাবে বলব সেভাবেই চলতে হবে, সেটা মেনে নেয়া ছাড়া আর কিছু কি করবার আছে? আর বাবার বাড়ি সে-তো বিয়ের পর পরের বাড়ি হয়ে যায়।

মেয়েরা কখনও স্বামীর মন রক্ষার্থে সংসার বাঁচাতে বাবার কাছে সহযোগিতা চায় আবার কখনও স্বামীর কাছে মাথা নত করে বাবার মান বাঁচাতে। অপমানিত লাঞ্ছিত জীবনটাকে কেউ যদি মুখ বুজে সহ্য করে যেতে পারে তবে সে ভূষিত হয় মহান বা আত্মত্যাগী মহিলা রুপে। কিন্ত কেউ যদি নিজের আত্মমর্যাদাবোধকে মুল্য দিয়ে অপমানিত জীবন মেনে নিতে না চায় তবে কি তাকে সমাজ ছেড়ে দেবে? “মুখরা” “কুলটা” অপবাদের বোঝা না দিয়েই?

এখন একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। ধরে নেই, সমাজ সংসার ধর্ম বাদ দিয়ে জঙ্গলকে কেউ বেছে নিল সুখের নিবাস হিসেবে। যেখানে কোনো দায় নেই। তারপরও কি কোনো মানুষ হলফ করে বলতে পারবে, সে ১০০% সুখি? তা যদি নাই হয় তবে সুখটা কথায়????

বাবা-মা ভাবে সন্তানকে কষ্ট করে মানুষ করলে বুড়ো বয়সে সুখ মিলবে। কিন্ত সেই সন্তান যখন বড় হয়ে মা-বাবাকে ফেলে নিজের সুখের সংসার গড়তে ব্যস্ত হয়ে ওঠে তখন?

আমার অনেক স্বপ্নে দেখা সুখের সংসার মাত্র তিন মাসের মাথায় ভেঙে গেল—সে কি কেবল আমার দোষে? ছোট ছিলাম তাই বুঝতে পারি নি, অথচ সব দায়ভার আমাকেই নিতে হয়েছিল। কারণ আমি মেয়ে হয়ে সুখের স্বপ্ন দেখেছিলাম। এরপর থেকে ছেলেদের আমি সহ্য করতে পারতাম না। ওদের কষ্টের মাঝেই আমি সুখ পেতাম। কিন্ত সেটা কি সত্যিকার অর্থে সুখ ছিল?

দ্বিতীয়বার আমার আবার বিয়ে হলো। ভাবলাম হয়ত এবার আমি সুখের সংসার গড়তে পারব। প্রথমবারে ছোট ছিলাম, তাই না বুঝে সব অন্যায় অত্যাচার সহ্য করেছি। এবার সংসার করব, কিন্ত অন্যায় সহ্য করব না মুখ বুজে। কিন্তু সুখপাখি কি ধরা দিয়েছিল আমার কাছে? সবাই বলল, বাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্ত বাচ্চা কি সংসার টিকাতে পেরেছিল!

উল্টো সেকেন্ডহ্যান্ড উপাধি নিয়ে সংসার ছাড়তে হলো। যদি সব মেনে নিতাম তাহলে কি সুখী হতাম? প্রথমবারে তো মেনে নিয়েছিলাম সবই। তাহলে কেন সংসার বাঁচাতে পারলাম না? এরপর যখন সংসার ছেড়ে দিলাম, তখনো কেন সুখ পেলাম না। বিয়ে ভাঙা এক অল্পবয়েসী মেয়ের দিকে কী চোখে তাকিয়েছে আমাদের এই সমাজ? এমনকি পরিবার আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব? এরা কি কেউ সহজভাবে নিতে পেরেছে ব্যাপারটা?

আর এখন এই যে আমি অজানা অচেনা এক দেশে বাস করছি। এখন কিভাবে দেখছে এখানকার বাঙালি সমাজ আমাকে? সংসার ছেড়েছি, দুই দুই বার বিয়ে ভেঙেছে, তার জন্যে যেন সবার শ্যেনদৃষ্টির সামনে আমি। যদি নিজেকে ভাসিয়ে দেই, তাহলে ওরা সবাই খুশি হয়ে বাহবা দেবে সামনে আর পেছনে অপবাদ দেবে কুলটা। কিন্ত যদি না দেই? তাহলেও কি ওরা ছেড়ে দেবে? আমার উপর পড়বে পুরুষের ইগো থেকে সৃষ্ট অসংখ্য সব অপবাদ।

এই যদি পরিস্থিতি হয় তাহলে সুখের পথে সামাজিক মূল্যবোধই কি অন্তরায়? নাকি গোটা পৃথিবীর পুরুষমানুষরাই এর জন্যে দায়ী? নাকি মানুষ জানেই না আসলে সুখ কি জিনিস।

আমি ধার্মিক, খুবই ধার্মিক। আমি প্রকৃতি ভালবাসি। ভালবাসি গাছপালা পশুপাখি। আমি বিশ্বাস করি আমি এক সফরে আছি। এই সফর শেষে যেতে হবে আরেক অনন্ত সফরে। হয়তো সেই জীবনে গিয়ে আমি আমার সুখের সন্ধান পাব।

আর এই জীবনে! এই জীবনে আমি অনেক সুখী। কারণ আমি স্রষ্টার কাছে নিজেকে সমর্পিত করেছি। মানুষের কল্যাণের মাঝেই আমি আমার সুখকে খুঁজে নিয়েছি।

একটা জিনিস আমি বুঝেছি, সেটা হলো চাওয়ার মাঝে কিন্তু কোনো সুখ নেই। সুখ আছে দেয়ার মাঝে। তাই আমি শুধুই দিতেই চাই। মন-প্রাণ উজাড় করে শুধুই দিতে চাই। ভালবাসা দিতে চাই অসহায় বঞ্চিতের মাঝে, প্রকৃতির মাঝে বিলিয়ে দিতে চাই আমার সমস্ত সত্ত্বা। সৃষ্টির লালনে বিলাতে চাই আমার ছোট এই জীবন।