বছরে সঞ্চয় আড়াই লাখ টাকা!

published : ২৮ এপ্রিল ২০১২

পেশাদার ভিক্ষুকদের নিয়ে গত ২০ বছর ধরেই বলে আসছে কোয়ান্টাম। বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দৈনিকের কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ফুটে ওঠে তারই প্রতিফলন। ‌‍২০১১ সালের জুলাইতে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল তেমনই এক প্রতিবেদন। পারভেজ খানের লেখা সেই তথ্যবহুল প্রতিবেদনটি আবারও আমরা তুলে ধরছি কোয়ান্টাম ওয়েবসাইটের পাঠকদের জন্যে।

প্রিয় পাঠক, পড়ুন, মন্তব্য করুন। জানাতে পারেন আপনার নিজের কোনো ঘটনাও যেখানে পেশাদার ভিক্ষুকদের প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন আপনি।

গতকাল সোমবার সকাল। আজিমপুর কবরস্থান এলাকা। সারা রাত খয়রাত সংগ্রহ শেষে চারজন ভিক্ষুক ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সবার বাড়ি কুড়িগ্রামে। সবাই একসঙ্গে ভিক্ষা করেছেন। চারজন মিলে টাকা পেয়েছেন ১৮ হাজার ৭৫২। সবই ১০ টাকা, পাঁচ টাকা আর দুই টাকার নোট। এখন চলছে ভাগবাটোয়ারা। টাকার সঙ্গে পেয়েছেন ৩০ কেজির মতো হালুয়া ও বেশ পরিমাণ রুটি, ১৬-১৭ প্যাকেট বিরিয়ানি। তাদের স্ত্রী-ছেলেমেয়েরাও ঘুরে বেড়িয়ে ভিক্ষা করেছে। সবার টাকা একসঙ্গে মেলানো হবে।

এই ভিক্ষুকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্ত্রী-সন্তানরা বাসায় বাসায় গিয়ে হালুয়া, রুটি ও মাংস সংগ্রহ করেছে। ভোরেই তারা ৩০ কেজি হালুয়া বিক্রি করে দিয়েছেন। গাবতলী এলাকার এক হোটেল মালিক তাদের কাছ থেকে এই হালুয়া কিনে নিয়েছেন ৩০ টাকা কেজি হিসাবে। যেগুলো বিক্রি হবে না, বাড়িতে নিয়ে বিশেষভাবে অনেক দিন রাখা হবে। কথা বলে জানা যায়, মিরপুর এলাকার কয়েকজন হোটেল মালিক আছেন যারা (কর্মচারীদের মাধ্যমে) প্রতিবছরই আজিমপুর কবরস্থানের সামনে এসে ভিক্ষুকদের কাছ থেকে হালুয়া কিনে নেন।

চার ভিক্ষুকের একজন আজমত শেখ জানান, রাজধানীর আজিমপুর বা হাইকোর্ট যে এলাকাতেই হোক না কেন, শবেবরাতের আগের দিন এসে তাদের জায়গা কিনে যেতে হয়। এবার তারা আজিমপুরের দুটি স্পট কিনেছেন এক রাতের জন্যে তিন হাজার টাকা দিয়ে। তাদের আরেকটি দল ভিক্ষা করছে চায়না বিল্ডিংয়ের সামনে। আজিমপুরে বটতলা, কবরস্থান এলাকা, নিউ পল্টন রোডের কয়েকজন সন্ত্রাসী ও কবরস্থানের কয়েকজন কর্মী এই স্পট বিক্রির ব্যবসা করে। এই টাকার একটি অংশ পুলিশও পায়। টাকা না দিলে তাদের বসতে দেওয়া হয় না।

চার ভিক্ষুকের আরেকজন নিয়ামত জানান, তারা কুড়িগ্রাম থেকে ট্রাকে করে আজিমপুর এসেছেন। শবেবরাত ও রোজাকে সামনে রেখে একটি পরিবহন চক্র তাদের আনা-নেওয়ার কাজ করে। এই চক্র বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রাক পাঠিয়ে তাদের আনা-নেওয়া করে। তাদের যে ট্রাকে করে আনা হয় সেই ট্রাকে রংপুর, বগুড়া, শেরপুর, চান্দাইকোনা, সিরাজগঞ্জ এবং টাঙ্গাইল থেকেও ভিক্ষুক তোলা হয়। তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি দেড় হাজার টাকা করে ভাড়া নেওয়া হয়েছে আসা ও যাওয়ার জন্যে। তারা সবাই রোজার ঈদের পর আবার ফিরে যাবেন। এর আগ পর্যন্ত তারা ঢাকাতেই থাকবেন। সারা দেশ থেকেই ভিক্ষুকরা এভাবেই আসা-যাওয়া করে বলে নিয়ামত জানান।

শবেবরাতের রাতে আজিমপুর, বায়তুল মোকাররম, মিরপুর ও হাইকোর্ট মাজার বা বনানী কবরস্থানে খয়রাতপ্রার্থী ভিক্ষুকদের 'হাট' বসে। মূলত শবেবরাতের আগের দিন সকাল থেকেই শুরু হয় ভিক্ষুকদের আসা। শবেবরাতের রাত শেষে পরদিন ফজরের আজানের পর থেকে কমতে শুরু করে। তবে অনেকে সন্ধ্যা পর্যন্তও থাকে। ফলে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্তও অনেকে এসব এলাকায় অবস্থান করছিল। তবে সংখ্যা নিতান্তই কম। পুলিশের মতে, শবেবরাত উপলক্ষে ঢাকায় কমপক্ষে ৫০ হাজার ভিক্ষুক আসে ঢাকার বাইরে থেকে।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে এসেছেন জামাল মিয়া। বয়স এখন ছাপ্পান্ন। 'আমরা সিজনাল ফকির। বার মাস ভিক্ষা করি না। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে আসি। রোজা আর শবেবরাত আমাদের ভালো সিজন। এরপর এক বছর চলে ভালোমতোই। তারপরও যা করি ওইটারে ওভারটাইম বলা যায়। বছরে খাওয়া খরচ বাদ দিয়ে আমাদের একেকজনের দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা থাকে।'

জামালের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের পাশে থাকা আরেক দলের সদস্য পঙ্গু আলেয়া বেগম বলেন, 'স্যার, আমাগো দুঃখের কথা কিছু লেইখেন। বাসওয়ালারা আমগো নিতে চায় না। ট্রেনেও উঠতে দেয় না। টেরাক ভাড়া কইরা এই কামে কি পোষানো যায়, কন?

আট-নয় বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল জামাল মিয়ার। এরপর থেকেই পঙ্গু। পরিবারের অবস্থা ভালো না। আর কোনোও কাজ করতে না পারায় ১০ বছর বয়স থেকে জামাল ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নেন। একপর্যায়ে টাঙ্গাইল, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জের আরো সাতজন পঙ্গু ভিক্ষুকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তখন সবাই মিলে পাঁচ সদস্যের একটি দল গঠন করেন। এরপর থেকেই চলছে তাদের এই যৌথ ভিক্ষাবৃত্তি। এখন তাদের পাঁচ সদস্যেরই হাতে পর্যাপ্ত টাকা আছে। বাড়িতেও সবাই ঘর দিয়েছেন। তার ঘর টিনশেডের। বিয়ে করেছেন। সন্তান আছে। দুই মেয়ে এক ছেলে। জমিও কিনেছেন এলাকায়। গরু কিনেছেন চারটি।

আজিমপুরে পাইপ কারখানার সামনে কোলের ওপর কোরআন শরিফ রেখে বিড়বিড় করে শব্দ করছিলেন এক ভিক্ষুক। নাম সুফিয়া বেগম। বয়স বড়জোর ৩০ বছর। স্বল্প আলো, এই আলোতে লেখা চোখে দেখার কথা নয়। তার কাছে গিয়ে জোরে শব্দ করে কোরআন পড়তে বলা হলে প্রথমে সুফিয়া ঘাবড়ে যান। শেষ পর্যন্ত সুফিয়া স্বীকার করেন, তিনি কোরআন পড়তে পারেন না। মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার জন্যে তিনি সঙ্গে কোরআন রেখে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সুফিয়ার বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। সুফিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে ভিড় জমে যায়। এগিয়ে আসেন দুজন পুলিশ সদস্য। এ সময় বিপদ আঁচ করতে পেরে বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে কোরআন শরিফ রেখেই পালিয়ে যান সুফিয়া। আর ফেরেন নি।

হাইকোর্ট মাজারের সামনে রাস্তায় হুইল চেয়ারে বসে ভিক্ষা করছিলেন এক ভিক্ষুক। পায়ে সাদা কাপড়ের জুতা। মুখে হালকা ছোট ছোট দাড়ি। এলাকায় সবাই তাকে ভিক্ষুকদের 'লিডার' বলেই যানে। আসল নাম কেউ জানে না। কাছে গিয়ে নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ফকিরের আবার নাম কী? আমারে সবাই লিডার কয়, কিছু লিখতে চাইলে এই নামেই লিখেন।

আমি ভিক্ষুক সমিতির হাইকোর্ট শাখার সভাপতি।' আরো কথা বলতে চাইলে তার সঙ্গে পরে যোগাযোগ করতে হবে বলে তিনি জানান। হাইকোর্ট মাজার এলাকার কয়েকজন স্থানীয় ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা বলেও এই নেতার নাম জানা যায় নি। কিছুক্ষণ পর 'লিডার'কে দেখা গেল হাইকোর্টের উল্টোপাশের ফুটপাতে। হুইল চেয়ারে নয়, হেঁটে বেড়াচ্ছেন। হাতে সিগারেট। অনেকটা বিরক্তের সঙ্গে বললেন, পা পঙ্গু হলেও বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারেন না। অনেকক্ষণ হুইল চেয়ারে বসে থাকায় মাজা ধরে গেছে। এ কারণে এখন একটু হাঁটছেন।

এলাকার কয়েকজন ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাইকোর্ট এলাকায় সাধারণত দিনে ভিক্ষা করতে এলে এই নেতাকে ২০ টাকা করে দিতে হয়। রাতে ঘুমাতে হলে আরো ২০ টাকা লাগে। আর শবেবরাতের দিনে এই টাকার পরিমাণ আরো বেশি  ৫০ থেকে ১০০। কেউ টাকা না দিলে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ভিক্ষুকদের মধ্যেও সন্ত্রাসী ও ক্যাডার আছে। এই নেতার দলে ক্যাডার হিসেবে কাজ করে ১০-১২ জন কিশোর ও যুবক ভিক্ষুক। এরা মূলত পঙ্গু ভিক্ষুকদের হুইল চেয়ার ঠেলে বেড়ায় এবং সারাদিন যা আয় হয়, তার অর্ধেক নিয়ে নেয়। ভাসমান যৌনকর্মীদের দালাল হিসেবেও এরা কাজ করে।

রবিবার শবেবরাতের রাতে দাদির কবর দেখতে বাবার সঙ্গে আজিমপুর কবরস্থানে এসেছে শিশু সৈকত। ভিড়ে হাঁটার উপায় নেই। কবর জিয়ারত করতে আসা লাখো পথচারী, তার ওপর রাস্তার দুই ধারসহ প্রায় পুরোটাই দখল করে রাখা হাজার হাজার ভিক্ষুকের আসর। এদের অধিকাংশই পঙ্গু। পঙ্গুত্ব আর বিকলাঙ্গের কারণে শারীরিকভাবেও অনেককে দেখাচ্ছিল বীভৎস। এ ধরনের কয়েকজন ভিক্ষুককে পথে ঘিরে রেখে পুরনো ক্ষতসহ শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকৃতভাবে দেখিয়ে ভিক্ষা করছিল কয়েকজন। এ দৃশ্যে ভয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে শিশু সৈকত। জানতে চায়, 'বাবা ওরা এ রকম করছে কেন? এত ভিক্ষুক থাকে কোথায়?'

আজিমপুর এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা ও স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ওসমান গনি, পিন্টু মুক্তি পরিষদের নেতা আনোয়ার হোসেন মাহবুব, ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান খান, ফারুক আহমেদসহ আরো কয়েকজন জানান, তারা নীতিগতভাবে ভিক্ষার বিরুদ্ধে। কিন্তু মানবিক কারণে তারা ভিক্ষুকদের কিছু বলতেও পারেন না। তাদের মতে, অনেক শিশুই এসব দেখে ভয় পায় এবং রাতে ঘুমের ঘোরেও তারা চিৎকার করে ওঠে। একমাত্র পুলিশের পক্ষেই সম্ভব এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।

এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ভিক্ষাবৃত্তি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ এবং এই আইনে ভিক্ষুককে গ্রেপ্তার করা যায়। অনেক সময় তাদের ধরে ঢাকার বাইরে ফেলে আসা হয় অথবা ভবঘুরে কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অতি মানবীয় কারণে শবেবরাতের সময় কোনো ভিক্ষুক গ্রেপ্তার করা হয় না। তিনি আরো বলেন, এক শ্রেণীর ভিক্ষুক আছে তাদের ভিক্ষা আদায়ের ধরন হচ্ছে অনেকটা অস্ত্র দেখিয়ে ছিনতাই করার মতোই। এটাও সম্পূর্ণ বেআইনি। এ ব্যাপারে তাদের ঊর্ধ্বতন মহলে কথাও হয়েছে। আগামী বছর থেকে তারা এ ব্যাপারে এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আগে থেকেই কঠোর ব্যবস্থা নেবেন বলে ঐ কর্মকর্তা জানান।