আধুনিক স্বাস্থ্য মহামারির নেপথ্য কারণ আল্ট্রা-প্রসেসড ফুড

কীভাবে খাদ্যোপযোগী করা হয়েছে তার ভিত্তিতে খাবারকে মোটা দাগে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়

অপ্রক্রিয়াজাত বা ঈষৎ প্রক্রিয়াজাত খাবার- খাদ্যোপযোগী প্রাকৃতিক কোনোকিছুকে যদি সরাসরি খাওয়া হয় তাহলে তা হবে অপ্রক্রিয়াজাত খাবার। ঈষৎ প্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্ষেত্রে খাদ্যবস্তুটি মজুদ, প্রস্তুত বা খাওয়ার জন্যে কিছুটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। 

আপনি যদি কালিজিরা দানা সরাসরি খান তাহলে তা হবে অপ্রক্রিয়াজাত খাবার। ঈষৎ প্রক্রিয়াজাত হবে যদি সেটা গুঁড়ো করে খান। 

ধোয়া, চূর্ণ করা, ফ্রিজে রাখা, পাস্তুরায়ন, গাঁজন, ফ্রিজিং- ইত্যাদির মাধ্যমে খাবার ঈষৎ প্রক্রিয়াজাত হলেও তা খাবারের পুষ্টিমানে তেমন একটা পরিবর্তন আনে না।

প্রক্রিয়াজাত ও অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারে থাকে বাড়তি কিছু 

প্রসেসড ফুড বা প্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্ষেত্রে লবণ, চিনি বা চর্বিযুক্ত করার মাধ্যমে খাবারের স্বাদ বাড়ানো হয়।

আর আল্ট্রা-প্রসেসড ফুড বা অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্ষেত্রে এগুলো ছাড়াও কৃত্রিম রং, ফ্লেভার, প্রিজারভেটিভ, থিকেনার, আর্টিফিসিয়াল সুইটেনার ইত্যাদি যুক্ত করা হয় বিপণন বা সংরক্ষণের সুবিধার্থে। স্বাদে-গন্ধে-চেহারায় লোভনীয় করতেই এতকিছু করা। আর এসবের মধ্যে দিয়ে খাবার হারায় তার ভিটামিন মিনারেল ফাইবারসহ যাবতীয় পুষ্টিগুণ। 

মিষ্টি পানীয়, কোমল পানীয়, আইসক্রিম, চকোলেট, ক্যান্ডি, সিরিয়াল, পাউরুটি, বিস্কুট, চিপস, ক্র্যাকারস, ইনস্ট্যান্ট স্যুপ, ফাস্ট ফুড, জাংক ফুড ইত্যাদি সবই আল্ট্রা-প্রসেসড ফুড। অধিকাংশ রেডি-টু-ইট খাবারই আল্ট্রা-প্রসেসড ফুডের মধ্যে পড়ে।    

যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে অর্ধেকেরও বেশি খাবার হচ্ছে এই আল্ট্রা-প্রসেসড ফুড। ক্রমান্বয়ে এসব অস্বাস্থ্যকর খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি আমরাও। পরিণামে ডেকে আনছি ভয়াবহ স্বাস্থ্য মহামারি।

গবেষণায় যা উঠে এসেছে    

সম্প্রতি আল্ট্রা-প্রসেসড ফুড বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের Johns Hopkins Bloomberg School of Public Health, অস্ট্রেলিয়ার the University of Sydney এবং ফ্রান্সের Sorbonne University-এর একটি যৌথ গবেষণা রিপোর্ট ছাপা হয়েছে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে। ৯৯ লক্ষ মানুষের ওপর পরিচালিত এই জরিপ গবেষণায় উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর তথ্য। 

গবেষকেরা আল্ট্রা-প্রসেসড ফুডের সাথে একটি দুটি নয়, ৩২টি রোগকে চিহ্নিত করেছেন! হার্ট লিভার কোলন পাকস্থলি- শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোই এসব রোগের শিকার। 

ক্যান্সার, হৃদরোগ ও টাইপ-টু ডায়াবেটিস- এই তিনের সাথে আল্ট্রা-প্রসেসড ফুড একবারে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত- বলছেন গবেষকেরা। এসব খাবার কার্ডিওভাসকুলার রোগে মৃত্যুঝুঁকি ৫০ শতাংশ, টাইপ-টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ১২ শতাংশ এবং উদ্বেগ-বিষণ্ণতার ঝুঁকি ৪৮ থেকে ৫৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। 

রক্তে উচ্চমাত্রার চর্বি, অ্যাজমা, মেদস্থূলতা, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল এবং বিপাকীয় স্বাস্থ্য সমস্যা তো আছেই! 

আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে

বেশি বেশি অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া আর যমদূতকে বাড়ির ঠিকানা চিনিয়ে দেয়া একই কথা! কারণ গবেষণায় এসব খাবারের সাথে যেসব রোগের সংযোগ পাওয়া গেছে সেগুলোর পরিণতি অকালমৃত্যু।

খেয়াল করলে দেখবেন যারা বেশি বেশি পিজ্জা বার্গার স্যান্ডউইচ সফটড্রিংকস খায় তারা একটু নাদুসনুদুস মোটাসোটা ওজনদার হয়ে থাকে। কারণ এসব খাবারের থাকা চিনি চর্বি ও লবণ ওজন বাড়িয়ে দেয়। আর বাড়টি ওজন মানে হার্ট, লিভার, কোলন ও পাকস্থলির নানাবিধ রোগের বাড়তি ঝুঁকি। এমনকি অল্প বয়সেই হতে পারে ডায়াবেটিস। 

এই ধরনের খাদ্যাভ্যাসের জেরে যে-কোনো রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি ২১ শতাংশ বাড়ে। হৃদরোগে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে ৪০-৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ, অকালমৃত্যুর সাথে আল্ট্রা-প্রসেসড ফুডের সম্পর্ক বেশ প্রগাঢ়!

এসব খাবার কেন আমাদের এত টানে? 

চিনি স্বাস্থ্যের জন্যে এতটাই ক্ষতিকর যে বিজ্ঞানীরা একে বলছেন হোয়াইট পয়জন বা সাদা বিষ। আল্ট্রা-প্রসেসড ফুডের অন্যতম প্রধান উপাদানই হলো এই সাদা চিনি। এমন ফাস্ট ফুড আপনি পাবেন না যাতে চিনি ব্যবহৃত হয় নি, তা মিষ্টি স্বাদের হোক বা না হোক। কারণটাও পরিষ্কার।  

শত শত গবেষণা রিপোর্টে চিনিকে এডিক্টিভ বা আসক্তিকর বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এলকোহলের মতোই চিনি আসক্তিকর বিধায় ফাস্ট ফুড অনেককে মাদকের মতো টানে। যত এগুলো খায়, খাওয়ার প্রবণতা ততো বাড়তে থাকে।

বাঁচতে করণীয়

করণীয় একটাই- ফাস্ট ফুড, জাংক ফুড, ডুবোতেলে ভাজা, চিনিযুক্ত খাবার তথা আল্ট্রা-প্রসেসড ফুড পুরোপুরি বর্জন। গবেষকেরা বলছেন, জাতিসঙ্ঘের উচিৎ হবে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্যে তামাক বিষয়ে যেমন কনভেনশন রয়েছে, আল্ট্রা-প্রসেসড ফুডের জন্যেও একইরূপ কনভেনশন প্রণয়ন।

আপনিও সচেতন হোন। প্রকৃতিতে যে খাবার যে অবস্থায় পাওয়া যায় চেষ্টা করুন সে অবস্থায় খেতে। 

যেমন ধরুন বাদাম। নামীদামী সুপারশপের প্যাকেটজাত ফ্রাইড সল্টি নাটের বদলে কাঁচা বাদাম ভিজিয়ে খাওয়াটাই সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর। 

কাঁচা সালাদ, আধসিদ্ধ সবজি, কম তাপে রান্না করা খাবারে অভ্যস্ত হোন। ইনস্ট্যান্ট বা প্যাকেট স্যুপের বদলে ঘরে বানানো স্যুপ খান। ফলের জ্যুসের বদলে ফলমূল খান সরাসরি চিবিয়ে।

আল্ট্রা-প্রসেসড ফুডের বদলে যত প্রাকৃতিক খাবারে আপনি অভ্যস্ত হবেন তত প্রাণপ্রাচুর্যে ভরে উঠবে আপনার জীবন। আপনি লাভ করবেন আমৃত্যু সুস্থতা।