পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ॥ আপনাকে রাখে সুস্থ, প্রাণবন্ত ও কর্মোদ্যমী

published : ১২ এপ্রিল ২০১৮

যূথবদ্ধতাই শক্তি

মানুষ একা নয়। কোনো না কোনোভাবে সে একত্রিত ও যূথবদ্ধ। পরিবারমুখিতা মানুষের চিরায়ত ও সহজাত প্রকৃতি। এ-ছাড়াও জীবনের পরতে পরতে বিভিন্ন উপলক্ষে সে ক্রমশ যুক্ত হতে থাকে নানা সামাজিক বন্ধনে। এসব সম্পর্কের গাঁথুনি যার জীবনে যতটা সুনিবিড় ও দৃঢ়, জীবনটাও তার কাছে ততটা উপভোগ্য ও সহজ। সমাজতাত্ত্বিকদের পর্যবেক্ষণে এ আজ এক সার্বজনীন সত্য।

কিন্তু শুধু অভিজ্ঞতা-পর্যবেক্ষণে সন্তুষ্ট নন একবিংশ শতকের বিজ্ঞানীকূল। তাদের চাই প্রমাণ, চাই শক্তপোক্ত তথ্য-উপাত্ত। যার হদিস মিললেই কেবল তারা এর পক্ষে রায় দেন। ঠিক তেমনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিচালিত হয়েছে বিশ্বজুড়ে খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

আর এ গবেষণার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা বলছেন, সুষম পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনে যারা বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে পান, তারা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘায়ু হন। আসল রহস্যটা এসব মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচারে-এদের খাদ্যাভ্যাস তুলনামূলক স্বাস্থ্যকর, এরা কমবেশি নিয়মিত ব্যায়াম করেন। সবমিলিয়ে তাদের জীবনধারা অনেকটাই সুস্থ। মানসিক দিক থেকেও তারা অধিকতর সক্ষম। কারণ তাদের গভীর বিশ্বাস- আসুক যতই কঠিন সময়, কেউ না কেউ পাশে এসে ঠিক দাঁড়াবেই।

পরিবার চিরসত্য, চিরসুন্দর ॥ পারিবারিক বন্ধনে বাড়ে আয়ু

পারিবারিক একাত্মতা জীবনকে সুন্দর করে। করে তোলে অর্থবহ। বিজ্ঞানীরা রীতিমতো জোর দিয়ে বলছেন, পারিবারিক সম্প্রীতির সাথে মানুষের দীর্ঘায়ু অর্জনের সম্পর্কটা একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত। তাদের মতে, বাবা-মা, সন্তান ও ভাইবোনদের সাথে কাটানো আনন্দঘন মুহূর্ত দীর্ঘায়ু লাভে বিশেষভাবে সহায়ক। কিন্তু পারিবারিক বন্ধন যাদের দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে ঘটতে পারে উল্টোটা।

পারিবারিক একাত্মতার সুফল মানুষ পেতে শুরু করে জীবনের গোড়া থেকেই। যেসব পরিবারে বাবা-মা ও সন্তানদের মাঝে উষ্ণ সম্পর্ক বিরাজমান, ক্যান্সারের মতো অসুখে পড়ার সম্ভাবনা তাদের কম। এবং এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যেসব পরিবারে একত্রে খাওয়াদাওয়ার রীতি চালু আছে, তারা তুলনামূলক সুস্থ খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত। সাম্প্রতিক আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, এসব পরিবারের শিশুরা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম।

৫৭ থেকে ৮৫ বছর বয়সী তিন হাজার মানুষের ওপর ২০১৬ সালে পরিচালিত হয় একটি বড় আকারের গবেষণা। যার ফলাফল উপস্থাপন করা হয় আমেরিকান সোশিওলজিক্যাল এসোসিয়েশনের বার্ষিক সভায়। তাতে বলা হয়েছে, এই প্রবীণদের মধ্যে যারা তাদের পরিবারের সদস্য ও আপনজনদের প্রতি গভীর সখ্যতা অনুভব করেন, তাদের মৃত্যুঝুঁকি পরবর্তী পাঁচ বছরে নেমে আসে ছয় শতাংশে। যারা একান্ত সম্পর্কগুলোতে উষ্ণতা খুঁজে পান না, তাদের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকি বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ শতাংশ।

গবেষকরা মনে করছেন, পরিবারের সদস্য ও প্রিয়জনদের প্রতি দায়িত্ববোধই এসব মানুষকে দীর্ঘজীবন লাভের ব্যাপারে আশাবাদী ও অনুপ্রাণিত করে তোলে। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যালা-লানা স্কুল অব পাবলিক হেলথের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক জেমস ইভেন্যুক বলেন, তাই আমাদের উচিত পরিবারের সদস্য-স্বজনদের সাথে আরো একাত্মতা বাড়ানো, কখনোই একে অন্যকে এড়িয়ে চলা নয়।

ভাইবোনে হৃদ্যতা ॥ বাড়ায় তৃপ্তি ও আনন্দ, কমায় উদ্বেগ ও বিষণ্নতা

আপনি ভালো আছেন, সুস্থ সুন্দর আনন্দময় জীবনযাপন করছেন, এর কিছু কৃতিত্ব দিতে হবে আপনার ভাইবোনদেরও। ভাইবোনের সাথে সম্পর্কটা যাদের মধুর, তারা দৈহিকভাবে তুলনামূলক সুস্থ এবং মানসিক দিক থেকেও প্রজ্ঞাপূর্ণ জীবনযাপন করেন। এমনটাই মত গবেষকদের।

২০১৫-তে ২৪৬টি পরিবারের সন্তানদের নিয়ে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভাইবোনের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এদের মধ্যে যারা যতটা ইতিবাচক ও একাত্ম, বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার হার ওদের ততটাই কম।

আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশেষত বোনদের সাথে একাত্মতা রয়েছে যাদের- একাকিত্ব, ভালবাসাহীনতা, আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব, উদ্বেগ, এমনকি ভয়ের মতো নেতিবাচক অনুভূতির আগ্রাসন তাদের জীবনে অনেক কম। আর বয়স এতে কোনো বাধা নয়। কারণ পরিণত বয়সের সুসম্পর্কধারী ভাইবোনদের নিয়ে পরিচালিত গবেষণাতেও দেখা গেছে, তারা অপেক্ষাকৃত সুখী ও আনন্দময় জীবনযাপন করেন। এ-ছাড়াও নিজেদের পাশাপাশি অন্য আত্মীয়স্বজনদের সাথেও বজায় থাকে তাদের সম্পর্কের উষ্ণতা।

দাম্পত্য সুসম্পর্কে প্রাপ্তি অশেষ

আপনার দাম্পত্যসঙ্গী অর্থাৎ স্বামী/ স্ত্রীর সাথে উষ্ণ ভাব-বিনিময় ও কথোপকথন আপনাদের সম্পর্কটাকে গভীর আর মজবুত করে তো বটেই, সেইসাথে রাখে সুস্থ, বাড়ায় দীর্ঘায়ুর সম্ভাবনা।

২০১৭ সালে ১৬২টি যুগলের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের পারস্পরিক আলাপনটা যেদিন সুখপ্রদ ও ইতিবাচক ছিল, সেদিন তারা একাকিত্বে ভুগেছেন কম, অনুভব করেছেন অধিকতর হৃদ্যতা এবং ব্যায়াম করার ব্যাপারে ছিলেন তুলনামূলক বেশি আগ্রহী। অন্যদিনের তুলনায় তাদের ঘুমটাও সেদিন হয়েছে বেশ ভালো।

এ প্রসঙ্গে ওয়াশিংটনের গনজাগা ইউনিভার্সিটির সাইকোলজিস্ট সারাহ অ্যারপিন বলেন, আপনার দৈনন্দিন জীবনের ইতিবাচক অভিজ্ঞতা-অনুভূতি ও সুখবরগুলো যখন আপনি দাম্পত্যসঙ্গীর সাথে শেয়ার করেন, তখন নিশ্চিতভাবেই এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে আপনার স্বাস্থ্যেও।

পারিবারিক ও সামাজিক একাত্মতা দেয় সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন কর্মব্যস্ত সুখী জীবন

বিশ্বজুড়ে আধুনিক ধারার সমাজবিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্য-গবেষকদের সাম্প্রতিক গবেষণার ভিত্তিতে এটা আজ এক প্রমাণিত সত্য যে, পারিবারিক ও সামাজিক একাত্মতা একজন মানুষকে সুস্থ সুখী সফল জীবনের পথে চালিত করে। তাই আমাদেরও উচিত এ যূথবদ্ধ জীবনযাপনের প্রতিটি সুযোগকেই কাজে লাগানো। এবং প্রয়োজন আমাদের উত্তরপ্রজন্মকেও সাধ্যমতো এমন জীবনধারায় অভ্যস্ত করে তোলা।

তাই যে-কোনো বিষয়ে পারিবারিক আলোচনা, পরিবারের সবাই অন্তত একবেলা একসাথে খাওয়া ইত্যাদি আচরণ-অভ্যাসের পাশাপাশি সঙ্ঘবদ্ধভাবে নৈতিকতার চর্চায়ও মনোযোগী হোন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রতি সপ্তাহে সাদাকায়ন-আলোকায়নসহ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিন। সেখানে অন্যদের সাথে পরিচিত হোন, পরিবারের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিন। সপ্তাহে অন্তত একদিন পরিবারে ধর্মবাণী পাঠ ও আলোচনার ব্যবস্থা করুন।

সুষম পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন আপনার ও আপনার পরিবারের সদস্য এবং প্রিয়জনদের পরিচালিত করুক সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন কর্মব্যস্ত সুখী জীবনের পথে।